শনিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১২

শরীয়াহ্ কি


শরীয়াহ্ কি :
‘শরীয়াহ্’ একটি আরবী শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ দীন, জীবন-পদ্ধতি, ধর্ম, জীবনাচার, নিয়ম-নীতি ইত্যাদি[1]। তবে আরবী ভাষায় শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ হল - পানির উৎসস্থল বা যে স্থান থেকে পানি উৎসারিত হয়ে গড়িয়ে পড়ে এবং মানুষ সেখানে এসে পানি পান করে পিপাসা নিবারণ করে[2]। শরীয়াহ্ যে জীবন পদ্ধতির অর্থে ব্যবহৃত হয়, কুরআনে সে ঘোষণা রয়েছে :
﴿ لِكُلّٖ جَعَلۡنَا مِنكُمۡ شِرۡعَةٗ وَمِنۡهَاجٗاۚ ﴾ [المائ‍دة: ٤٨] 
‘‘তোমাদের প্রত্যেকের জন্য শরীয়াহ‌ ও জীবন-পদ্ধতি নির্ধারণ করেছি।’’ [সূরা আল-মায়িদাহ : ৪৮]
Wikipedia, the free Encyclopedia তে শরীয়াহ্ সম্পর্কে এভাবে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে- Sharia (Arabic: شريعة transliteration: Šarī`ah) is the body of Islamic religious law. The term means "way" or "path to the water source"; it is the legal framework within which the public and some private aspects of life are regulated for those living in a legal system based on Islamic principles of jurisprudence and for Muslims living outside the domain. Sharia deals with many aspects of day-to-day life, including politics, economics, banking, business, contracts, family, sexuality, hygiene, and social issues.
পরিভাষায় ‘শরীয়াহ্’ এর সংজ্ঞায় প্রখ্যাত তাবেয়ী ক্বাতাদাহ রহ. বলেন, ‘‘শরীয়াহ্ হচ্ছে আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে আরোপিত নির্দেশ, নিষেধাজ্ঞা, সীমারেখা ও ফারায়েয।’’[3]
ইমাম ইবনু তাইমিইয়াহ রহ. বলেন, ‘‘আল্লাহ তাআলা যে সব আকীদা ও আমল মানুষের জন্য প্রণয়ন করেছেন, তা-ই শারীয়াহ্’’[4]। অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘‘শরীয়াহ্ হচ্ছে আল্লাহ তাআলা, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও উলুল আমর (তথা মুসলিম প্রশাসক ও আমীর) এর আনুগত্য করা’’[5]

ইসলামী শরীয়াহ্ এর সংজ্ঞা আরো সহজভাবে আমরা এভাবে দিতে পারি, ‘‘মহান আল্লাহ তাআলা জীবন ও জগত পরিচালনার জন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মাধ্যমে স্বীয় বান্দাদেরকে যে সার্বিক হুকুম ও বিধান প্রদান করেছেন, তা-ই হল ইসলামী শরীয়াহ্’’। এ সংজ্ঞার আলোকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার যাবতীয় আদেশ-নিষেধ ও এতদুভয়ের ভিত্তিতে ফরয-ওয়াজিব, সুন্নাত, মাকরুহ ও হারাম ইত্যাদি যে সকল বিধান প্রণয়ন করা হয় তা হচ্ছে শরীয়াহ্।

‘আশ-শরীয়াহ’ বলতে সাধারণত ‘আদ্-দীন’ তথা সার্বিক ইসলামী জীবন-বিধানকে বুঝানো হয়। তবে ‘শরীয়াহ্’ বলতে কখনো ইসলামের আইনগত দিককেও বুঝানো হয়। সেটি হচ্ছে শরীয়াহ্-এর খাস বা বিশেষ অর্থ।

ইসলামী শরীয়াহ্ এর দলীল ও উৎসসমূহ :
ইসলামী শরীয়াহ্ এর প্রধান উৎস ও দলীল চারটি। সেগুলো হলঃ
  • আল-কুরআন : ইসলামী শরীয়াহ্ এর সর্বপ্রথম ও সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ উৎস হচ্ছে আল-কুরআনুল কারীম। এ ব্যাপারে সকল সাহাবায়ে কিরাম (রাদিয়াল্লাহু আনহুম আজমায়ীন), সকল যুগের ইমামগণ, মুফাসসিরীন, মুহাদ্দিসীন, ফুকাহা ও সকল উলামায়ে কিরামের ঐকমত্য ও ইজমা রয়েছে। ইসলামী শরীয়াহ্ এর সকল বিধানই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পবিত্র কুরআন কারীম থেকে উৎসারিত। ইতোপূর্বে উল্লেখিত দু’টো আয়াতে [সূরা আল-জাসিয়া : ১৮ ও সূরা আল-মায়িদাহ : ৪৮] বলা হয়েছে যে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা নিজেই শরীয়াহ্ প্রণয়নকারী।
  • আস-সুন্নাহ্ : রাসূলুল্লাহ সা. এর কথা, কাজ, সম্মতি ও অনুমোদনকে বলা হয় আস্-সুন্নাহ। আস্-সুন্নাহ্ মূলত কুরআনেরই ব্যাখ্যা। আল্লাহ তাআলা বলেন,
﴿ وَأَنزَلۡنَآ إِلَيۡكَ ٱلذِّكۡرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيۡهِمۡ وَلَعَلَّهُمۡ يَتَفَكَّرُونَ ٤٤ ﴾ [النحل: ٤٤] 
‘‘আর আমি তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি, মানুষকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেবার জন্য যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছিল, যাতে তারা চিন্তা করে।’’ [সূরা আন-নাহল : ৪৪]
তিনি আরো বলেন,
﴿ وَمَا يَنطِقُ عَنِ ٱلۡهَوَىٰٓ ٣ إِنۡ هُوَ إِلَّا وَحۡيٞ يُوحَىٰ ٤ ﴾ [النجم : ٣،  ٤] 
‘‘সে মনগড়া কথা বলে না। এতো অহী যা তার প্রতি প্রত্যাদেশ হয়।’’ [সূরা আন-নাজম : ৩-৪]
আল-কুরআন ও সুন্নাহ দু’টোই যে অহী, এ ব্যাপারে আলেমগণের ঐকমত্য রয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, হাদীস শাস্ত্রের উসূল অনুযায়ী সুন্নাহ্-এর যে সকল হাদীস Authentic ও সহীহ শুধু সেগুলোই ইসলামী শরীয়ায় দলীল হিসেবে গৃহীত।
  • আল-ইজমা’ : ইজমা’ হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যুর পর মুসলিম উম্মাহর মুজতাহিদগণ কোনো এক যুগে শরীয়াহ্ এর কোন এক বিধানের উপর একমত হওয়া।[6] ইজমা’র জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল কুরআনের বিপরীত কোনো কিছুর উপর একমত না হওয়া। এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
إن الله لا يجمع أمتي على ضلالة
‘‘আমার উম্মাতকে আল্লাহ ভ্রষ্টতার উপর কখনো একমত করবেন না।’’[7] ইজমা’র বিধানের গুরুত্বের প্রতি ইঙ্গিত করে কুরআনে বলা হয়েছে,
﴿ وَمَن يُشَاقِقِ ٱلرَّسُولَ مِنۢ بَعۡدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُ ٱلۡهُدَىٰ وَيَتَّبِعۡ غَيۡرَ سَبِيلِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ نُوَلِّهِۦ مَا تَوَلَّىٰ وَنُصۡلِهِۦ جَهَنَّمَۖ وَسَآءَتۡ مَصِيرًا ١١٥ ﴾ [النساء : ١١٥] 
‘‘কারো নিকট হেদায়াত প্রকাশ হওয়ার পর সে যদি রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করে এবং মুমিনদের পথ ব্যতীত অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে যেদিকে সে ফিরে যায় সেদিকেই তাকে ফিরিয়ে দেব এবং জাহান্নামে তাকে দগ্ধ করব।’’ [সূরা আন-নিসা : ১১৫]
  • আল-কিয়াস : কিয়াস হচ্ছে কোনো বিষয়ের জন্য সে বিধান নির্ধারণ করা, যে বিধান স্পষ্টভাবে অন্য একটি বিষয়ের জন্য কুরআন বা হাদীসে বর্ণনা করা আছে, উভয় বিষয়ের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধানকারী ‘ইল্লাত’ বা হেতু থাকার কারণে।[8] কিয়াস যে শরীয়াহ্-এর উৎস ও প্রমাণ সে বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহের বহু দলীল রয়েছে।[9]
এগুলোর পাশাপাশি ইসলামী শরীয়াহ্-এর কয়েকটি আনুসাঙ্গিক ও গৌণ উৎস রয়েছে, যথাঃ মাসালিহ মুরসালাহ, ইস্তেহসান, ইস্তেসহাব ইত্যাদি। এগুলোর প্রত্যেকটিই কুরআন ও সুন্নাহ্ এর এর সমর্থনপুষ্ট ও এতদুভয়ের সাথে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণ।


[1] আস-সিহাহ,ইসমাইল ইবনু হাম্মাদ আল-জাওহারী, ৩/১২৩৬, লিসানুল আরব, ইবনু মানযূর, ৮/১৭৪
[2] লিসানুল আরব, ৮/১৭৪
[3] আল-জামি’ লিআহকামিল কুরআন ৬/২১১
[4] মাজমু’ আল-ফাতাওয়া, ইবনু তাইমিয়াহ, ১৯/৩০৬
[5] প্রাগুক্ত, ১৯/৩০৯
[6]  আল-মুস্তাসফা, ইমাম গাযালী, ১/১৭৩, শারহি আল-কাওকাব আল-মনীর, ইবনুন নাজ্জার, ২/২১১
[7]  সুনান আত-তিরমিযী, হাদীস নং ২০৯৩, এছাড়াও এ হাদীস বর্ণনা করেছে ইমাম আহমাদ ও হাকেম।
[8]  আল-বুরহান, ইমামুল হারামাইন, ২/৩৮৭, আল-মুস্তাসফা, ইমাম গাযালী, ২/২২৮, আল-মাহসূল, ইমাম রাযী, ৫/৫
[9]  বিস্তরিত দলীলসমূহ জানার জন্য দেখখুন, আল-কিয়াস ফিল ইবাদাত, পৃঃ ১৮৫-২২৫

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন