তাওহীদ পরিচিতি-6
অনুবাদ: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
উলুহিয়্যাতের ক্ষেত্রে আল্লাহর একত্ববাদ প্রতিষ্ঠা
করা রুবুবিয়্যাতের ক্ষেত্রে একত্ববাদ মেনে নেয়ার অপরিহার্য্য দাবী
এর অর্থ হচ্ছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর জন্য তাওহীদুর
রুবুবিয়্যাহ তথা রুবুবিয়্যাতের ক্ষেত্রে একত্ববাদকে স্বীকার করে নেয়, যেমন সে এ
স্বীকৃতি প্রদান করে যে, মহান আল্লাহ ছাড়া জগতের কোন স্রষ্টা নেই, রিযিকদাতা নেই,
পরিচালনাকারী নেই, তার জন্য এ স্বীকৃতি দেওয়াও অপরিহার্য্য হয়ে উঠে যে, সকল প্রকার
ইবাদাতের হক্বদার আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। আর এটিই
হল তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ তথা ইবাদাতের ক্ষেত্রে আল্লাহর একত্ববাদের ঘোষণা। কেননা
উলুহিয়্যাতের অর্থ হচ্ছে ইবাদাত। আর ‘ইলাহ’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে মা‘বুদ বা উপাস্য। সুতরাং আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে আহ্বান করা
যাবে না, কারো কাছে দো‘আ করা যাবে না, আল্লাহর কাছে ছাড়া
আর কারো কাছে সাহায্য প্রার্থনা করা যাবে না। তাঁর উপরই কেবল তাওয়াক্কুল ও
নির্ভরতা স্থাপন করা যাবে। যত কুরবানী শুধু তাঁর জন্যই যবেহ করা হবে এবং মানত শুধু
তাঁর নামেই করা হবে। সকল প্রকার ইবাদাত শুধু তাঁর জন্যই পালন করা হবে। অতএব
তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ হচ্ছে তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ অপরিহার্য্য হওয়ার দলীল বা
প্রমাণ। এজন্যই অনেক সময় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাওহীদুল উলুহিয়্যাহকে যারা
অস্বীকার করে তাদের উপর সে সব বিষয় দ্বারা দলীল পেশ করেছেন, তাওহীদুর রুবুবিয়্যার
যে বিষয়ে তারা স্বীকৃতি প্রদান করত। যেমন আল্লাহ তা‘আলার
বাণী,
﴿ يَٰٓأَيُّهَا ٱلنَّاسُ ٱعۡبُدُواْ رَبَّكُمُ ٱلَّذِي خَلَقَكُمۡ
وَٱلَّذِينَ مِن قَبۡلِكُمۡ لَعَلَّكُمۡ تَتَّقُونَ ٢١ ٱلَّذِي جَعَلَ لَكُمُ ٱلۡأَرۡضَ
فِرَٰشٗا وَٱلسَّمَآءَ بِنَآءٗ وَأَنزَلَ مِنَ ٱلسَّمَآءِ مَآءٗ فَأَخۡرَجَ بِهِۦ
مِنَ ٱلثَّمَرَٰتِ رِزۡقٗا لَّكُمۡۖ فَلَا تَجۡعَلُواْ لِلَّهِ أَندَادٗا وَأَنتُمۡ
تَعۡلَمُونَ ٢٢﴾ [البقرة: ٢١، ٢٢]
‘‘হে মানবমণ্ডলী! তোমরা
তোমাদের সেই রবের ইবাদাত করো যিনি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং তোমাদের
পূর্ববর্তীদেরকেও সৃষ্টি করেছেন যেন তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করো। তিনি তোমাদের জন্য
যমীনকে বিছানা করেছেন আর আকাশকে করেছেন ছাদ। আর আকাশ থেকে পানি বর্ষণ করে তা
দ্বারা তোমাদের রিযিকস্বরূপ ফলমূল উৎপাদন করেছেন। সুতরাং তোমরা জেনে শুনে আল্লাহর
জন্য কোন সমকক্ষ স্থির করো না।’’[1]
অতএব আল্লাহ বান্দাদেরকে তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ মেনে নেয়ার
নির্দেশ প্রদান করেছেন। আর এ প্রকারের তাওহীদ হচ্ছে তাঁরই ইবাদাতের নাম। তিনি
তাদের কাছে তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ দিয়ে দলীল পেশ করেছেন, যে তাওহীদের মানেই হচ্ছে
পূর্ববর্তী পরবর্তী সকল মানুষের সৃষ্টি, আসমান ও যমীন এবং এতদুভয়ের মধ্যে যা কিছু
আছে সবকিছুর সৃষ্টি, বাতাসকে অনুগত করা, বৃষ্টিবর্ষণ, উদ্ভিদ উৎপাদন এবং সে সব
ফলমূল সৃষ্টি করা যা বান্দাদের রিযিক বলে বিবেচিত। সুতরাং বান্দাদের জন্য এটা
সমীচিন নয় যে, তারা তাঁর সাথে অন্য এমন কারোর শরীক করবে যাদের ব্যাপারে তারা জানে
যে, ওরা এ সবের কোন কিছু কিংবা অন্য কিছুও করেনি। অতএব তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ
প্রমাণের স্বভাবজাত পন্থা হচ্ছে এ ধরনের তাওহীদের উপর তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ দিয়ে
প্রমাণ পেশ করা। কেননা মানুষ প্রথমত তার সৃষ্টির উৎস, তার কল্যাণ ও অকল্যাণের
প্রতি ঔৎসুক্য দেখায়। তারপর সে ঐ সব মাধ্যমের প্রতি তার মনোযোগ স্থির করে যা তাকে
সে উৎসের নিকবর্তী করে দেয় এবং যা তার মনপুত আর তার নিজের ও সে উৎসের মধ্যকার
সম্পর্ককে মজবুত করে।
অতএব তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ হচ্ছে তাওহীদুল উলুহিয়্যার
প্রবেশদ্বার। এজন্যই আল্লাহ এ পন্থায় মুশরিকদের উপর দলীল পেশ করেছেন এবং তাঁর
রাসূলকে এ পন্থা দ্বারাই মুশরিকদের বিরুদ্ধে দলীল পেশ করার নির্দেশ প্রদান করেছেন।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ قُل لِّمَنِ ٱلۡأَرۡضُ وَمَن فِيهَآ إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ
٨٤ سَيَقُولُونَ لِلَّهِۚ قُلۡ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ ٨٥ قُلۡ مَن رَّبُّ ٱلسَّمَٰوَٰتِ
ٱلسَّبۡعِ وَرَبُّ ٱلۡعَرۡشِ ٱلۡعَظِيمِ ٨٦ سَيَقُولُونَ لِلَّهِۚ قُلۡ أَفَلَا تَتَّقُونَ
٨٧ قُلۡ مَنۢ بِيَدِهِۦ مَلَكُوتُ كُلِّ شَيۡءٖ وَهُوَ يُجِيرُ وَلَا يُجَارُ عَلَيۡهِ
إِن كُنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٨٨ سَيَقُولُونَ لِلَّهِۚ قُلۡ فَأَنَّىٰ تُسۡحَرُونَ ٨٩ ﴾ [المؤمنون : ٨٤، ٨٩]
‘‘তুমি জিজ্ঞাসা কর, এ যমীন এবং এতে যারা আছে তারা কার মালিকানাধীন
যদি তোমরা জেনে থাকো? তারা বলবে, আল্লাহরই মালিকানাধীন। বল, তবুও কি তোমরা শিক্ষা
গ্রহণ করবেনা? তুমি জিজ্ঞাসা কর, কে সপ্তাকাশ ও মহা আরশের অধিপতী? তারা বলবে, আল্লাহ।
বল, তবুও কি তোমরা সতর্ক হবে না? তুমি জিজ্ঞাসা কর, সকল কিছুর কর্তৃত্ব কার হাতে?
যিনি আশ্রয় দান করেন এবং যার উপর আশ্রয়দাতা নেই, যদি তোমরা জেনে থাকো। তারা বলবে,
আল্লাহ। বল, তবু তোমরা কেমন করে মোহগ্রস্ত হচ্ছো?’’[2]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿ذَٰلِكُمُ
ٱللَّهُ رَبُّكُمۡۖ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَۖ خَٰلِقُ كُلِّ شَيۡءٖ فَٱعۡبُدُوهُۚ
﴾ [الانعام: ١٠٢]
‘‘তিনি আল্লাহ তোমাদের প্রভূ। তিনি ছাড়া আর প্রকৃত কোন ইলাহ নেই।
তিনি সবকিছুর স্রষ্টা। সুতরাং তাঁর ইবাদাত করো।’’[3]
আল্লাহ রুবুবিয়্যাতের ক্ষেত্রে তাঁর একত্ববাদের দলীল
দিয়ে তিনি যে ইবাদাতের হক্বদার সে বিষয়ের উপর প্রমাণ পেশ করেছেন। আর তাওহীদুল
উলুহিয়্যাহ প্রতিষ্ঠার জন্যই আল্লাহ
সৃষ্টিজগতকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ
তা‘আলা বলেন,
﴿ وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦
﴾ [الذاريات: ٥٦]
‘‘আর আমি জ্বীন ও ইনসানকে একমাত্র আমার ইবাদাতের জন্যই
সৃষ্টি করেছি।’’[4]
‘‘আমার ইবাদাতের জন্য’’ কথাটির অর্থ হচ্ছে তারা
শুধুমাত্র আমারই ইবাদাত করবে। বান্দা শুধুমাত্র তাওহীদুর রুবুবিয়্যার ব্যাপারে
স্বীকৃতি জ্ঞাপনের মাধ্যমে একত্ববাদী হতে পারে না যতক্ষণ না সে তাওহীদুল
উলুহিয়্যার স্বীকৃতি প্রদান করবে এবং তা কার্যে পরিণত করবে। অন্যথায় মুশরিকরা তো
তাওহীদুর রুবুবিয়্যার প্রতি স্বীকৃতি জ্ঞাপন করেছিল, অথচ সে স্বীকৃতি তাদেরকে
ইসলামে প্রবেশ করায় নি এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের
সাথে জিহাদ করেছিলেন। যদিও তারা এ স্বীকৃতি প্রদান করত যে, আল্লাহই স্রষ্টা, রিযিকদাতা,
জীবনদাতা ও মৃত্যুদানকারী। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ وَلَئِن سَأَلۡتَهُم مَّنۡ خَلَقَهُمۡ لَيَقُولُنَّ ٱللَّهُۖ
﴾ [الزخرف: ٨٧]
‘‘যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, কে তাদেরকে সৃষ্টি
করেছে? তারা অবশ্যই অবশ্যই বলবে, আল্লাহ।’’[5]
﴿وَلَئِن سَأَلۡتَهُم مَّنۡ خَلَقَ ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضَ
لَيَقُولُنَّ خَلَقَهُنَّ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡعَلِيمُ ٩ ﴾ [الزخرف:
٩]
‘‘যদি তুমি তাদেরকে জিজ্ঞাসা কর, কে আকাশমণ্ডলী ও যমীন
সৃষ্টি করেছে? তারা অবশ্যই অবশ্যই বলবে, মহা পরাক্রমশালী প্রজ্ঞাবান এগুলোকে সৃষ্টি
করেছেন।’’[6]
﴿ قُلۡ مَن يَرۡزُقُكُم مِّنَ ٱلسَّمَآءِ وَٱلۡأَرۡضِ أَمَّن
يَمۡلِكُ ٱلسَّمۡعَ وَٱلۡأَبۡصَٰرَ وَمَن يُخۡرِجُ ٱلۡحَيَّ مِنَ ٱلۡمَيِّتِ وَيُخۡرِجُ
ٱلۡمَيِّتَ مِنَ ٱلۡحَيِّ وَمَن يُدَبِّرُ ٱلۡأَمۡرَۚ فَسَيَقُولُونَ ٱللَّهُۚ ﴾ [يونس : ٣١]
‘‘বল, কে তোমাদেরকে আকাশ ও যমীন হতে জীবিকা সরবরাহ করে
অথবা শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি কার কর্তৃত্বাধীন? জীবতকে মৃত হতে কে বের করেন এবং মৃতকে
জীবিত হতে কে বের করেন? এবং সকল বিষয় কে নিয়ন্ত্রণ করেন? তখন তারা বলবে, আল্লাহ।’’[7]
আল-কুরআনে এরকম আরো বহু আয়াত রয়েছে। অতএব যে ব্যক্তি এ
ধারণা রাখে যে, তাওহীদ হচ্ছে শুধু আল্লাহর অস্তিত্বের স্বীকৃতি দেয়া অথবা এ
স্বীকৃতি দেয়া যে, আল্লাহই হচ্ছেন স্রষ্টা এবং জগতের কর্মবিধায়ক আর এ প্রকারের
উপরেই সে তার স্বীকৃতিকে সীমাবদ্ধ রাখে, তাহলে তাওহীদের হাক্বীকাত সম্পর্কে সে
জানে বলে বিবেচিত হবে না, যে তাওহীদের দিকে আহ্বান করেছিলেন রাসূলগণ। কেননা সে
অপরিহার্য্য বিষয়টি ছেড়ে যার জন্য অপরিহার্য্য সেটির কাছে থেমে গেছে। অন্যকথায় সে
দলীলের নির্দেশনা ত্যাগ করে দলীলের কাছে থেমে গেছে।
আল্লাহর উলুহিয়্যাতের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল সকল দিক থেকেই
এতে রয়েছে পরম পূর্ণতা, যাতে কোন দিক থেকেই কোন ধরনের ত্রুটি নেই এবং এটি সব
ইবাদাত একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত হওয়াকে অপরিহার্য করে। অনুরূপভাবে সম্মান
প্রদর্শন, ভয়, দো‘আ, আশা, আল্লাহর দিকে ফিরে আসা, তাওয়াক্কুল ও নির্ভরতা, সাহায্য
প্রার্থনা, পরম ভালবাসার সাথে অবনত হওয়া ইত্যাদি সব কিছুই বিবেক, শরী‘আত ও ফিতরাতের
দিক থেকে একমাত্র আল্লাহর জন্যই নির্ধারিত হওয়াকে অপরিহার্য করে তোলে। আর আল্লাহ
ছাড়া অন্য কারো জন্য এগুলো পালন করা বিবেকের দিক থেকে, শরী‘আতে র দিক থেকে এবং ফিতরাতের দিক থেকে নিষিদ্ধ বলেই বিবেচিত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন