তাওহীদ পরিচিতি-8
অনুবাদ: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
প্রথম
পরিচ্ছেদ
তাওহীদুল
উলুহিয়্যার অর্থ ও এটি যে রাসূলগণের দাওয়াতের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় সে প্রসঙ্গে
তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ : ‘আল-উলুহিয়্যাহ’ এর অর্থ হচ্ছে
ইবাদাত।
আর তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ হচ্ছে - বান্দা যেসব কাজ শরী‘আত সম্মত উপায়ে শুধুমাত্র আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের জন্য করে থাকে, সেসব কাজ দ্বারা কেবলমাত্র
আল্লাহ তা‘আলাকেই উদ্দেশ্য করা, যেমন
দো‘আ, মানত, যবেহ, আশা পোষণ, ভয়, তাওয়াক্কুল বা নির্ভরতা, আল্লাহর প্রতি আকর্ষণ,
সম্ভ্রম ও আল্লাহর কাছে ফিরে আসা ইত্যাদি। এ প্রকার তাওহীদই শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত
যত রাসূল এসেছেন সব রাসূলের দাওয়াতের মূল বিষয়। আল্লাহ
তা‘আলা বলেন,
﴿ وَلَقَدۡ بَعَثۡنَا فِي كُلِّ أُمَّةٖ رَّسُولًا أَنِ ٱعۡبُدُواْ
ٱللَّهَ وَٱجۡتَنِبُواْ ٱلطَّٰغُوتَۖ ﴾ [النحل:
٣٦]
‘‘আর আমি প্রত্যেক জাতির মধ্যে অবশ্যই রাসূল প্রেরণ করেছিলাম দিয়ে
এ নির্দেশ দিয়ে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তাগুতকে বর্জন করো।’’[1] আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿ وَمَآ أَرۡسَلۡنَا مِن قَبۡلِكَ مِن رَّسُولٍ إِلَّا نُوحِيٓ
إِلَيۡهِ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّآ أَنَا۠ فَٱعۡبُدُونِ ٢٥ ﴾ [الانبياء: ٢٥]
‘‘আর আমি আপনার পূর্বে যে রাসূলই প্রেরণ করেছিলাম তার কাছে এ
প্রত্যাদেশ করেছিলাম যে, আমি ছাড়া প্রকৃত আর কোন ইলাহ নেই। সুতরাং তোমরা আমারই
ইবাদাত করো।’’[2]
প্রত্যেক রাসূল তাঁর জাতির প্রতি দাওয়াতী কার্যক্রম শুরু
করেছিলেন তাওহীদুল উলুহিয়্যার নির্দেশ প্রদানের মাধ্যমে। যেমন নূহ, হূদ, সালেহ ও শু‘আইব
আলাইহিস সাল্লাম বলেছিলেন,
﴿ يَٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرُهُۥٓۚ
﴾ [الاعراف: ٦٤]
আল্লাহ আরো
বলেন,
﴿ وَإِبۡرَٰهِيمَ إِذۡ قَالَ لِقَوۡمِهِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَٱتَّقُوهُۖ
﴾ [العنكبوت: ١٦]
‘‘আর ইবরাহীমকেও, যখন তিনি তাঁর জাতিকে বলেছিলেন, আল্লাহর ইবাদাত
করো এবং তাঁর তাকওয়া অবলম্বন করো।’’[4]
তিনি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উপর নাযিল
করেছিলেন,
﴿ قُلۡ إِنِّيٓ أُمِرۡتُ أَنۡ أَعۡبُدَ ٱللَّهَ مُخۡلِصٗا لَّهُ
ٱلدِّينَ ١١ ﴾ [الزمر: ١١]
‘‘বল, আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যাতে আমি আল্লাহর
আনুগত্যে একনিষ্ঠ হয়ে তাঁর ইবাদাত করি।’’[5]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«أُمِرْتُ أَنْ أُقَاتِلَ النَّاسَ حَتَّى يَشْهَدُوا أَنْ لَا
إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُولُ اللَّهِ»
‘‘আমাকে মানুষের সাথে জিহাদ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যতক্ষণ না
তারা এই সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর
রাসূল।’’[6]
শরী‘আতে র
হুকুম প্রযোজ্য হয় এমন সকল ব্যক্তির উপর প্রথম যে বিষয়টি ওয়াজিব তা হচ্ছে, এ কথার
সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া আর প্রকৃত
কোন ইলাহ নেই এবং সে সাক্ষ্য অনুযায়ী আমল করা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ فَٱعۡلَمۡ أَنَّهُۥ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا ٱللَّهُ وَٱسۡتَغۡفِرۡ
لِذَنۢبِكَ ﴾ [محمد : ١٩]
‘‘জেনে রাখ, আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাই নেই এবং তোমার পাপের জন্য
ক্ষমা প্রার্থনা কর।’’[7]
যে ব্যক্তি ইসলামে প্রবেশ করতে চায় তাকে প্রথম যে
নির্দেশটি দেয়া হয় তা হচ্ছে দু’টো শাহাদাত বাণী উচ্চারণ। এর দ্বারা স্পষ্ট হয়েছে
যে, তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ বা ইবাদাতে একত্ববাদই হচ্ছে রাসূলগণের দাওয়াতের মূল
উদ্দেশ্য। আর তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ- এ নামকরণ এজন্যই করা হয়েছে যে, উলুহিয়্যাহ
হচ্ছে আল্লাহর গুণ, যার উপর আল্লাহর ‘আল্লাহ’ নামটি প্রমাণ বহন করছে। কেননা আল্লাহ
হচ্ছে উলুহিয়্যাতের মালিক অর্থাৎ উপাসনার অধিকারী বা উপাস্য। এ প্রকার তাওহীদকে
‘তাওহীদুল ইবাদাহ’ও বলা হয় এ বিবেচনায় যে, দাসত্ব হচ্ছে বান্দার গুণ। কেননা
একনিষ্ঠ হয়ে আল্লাহর ইবাদাত করাটা বান্দার উপর অপরিহার্য। কারণ সে তার রবের
মুখাপেক্ষী এবং রবের কাছে তার প্রয়োজন রয়েছে।
শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়্যাহ রাহেমাহুল্লাহু বলেন,
‘‘জেনে রাখো, আল্লাহর প্রতি বান্দার মুখাপেক্ষীতা হল এই যে, সে আল্লাহর ইবাদাত
করবে, তাঁর সাথে কোন কিছুর শরীক করবে না। তাঁর এমন কোন সমকক্ষ নেই যে, তাঁর সাথে
অন্য কিছুর তুলনা করা যেতে পারে। তবে কোন কোন দিক থেকে এর সাথে অন্যের কিছুটা
তুলনা হতে পারে যেমন খাদ্য ও পানীয়ের প্রতি শরীরের মুখাপেক্ষীতা। তবে এ দুটোর
মধ্যে বহু পার্থক্য রয়েছে। কেননা বান্দার হাক্বীকাত হচ্ছে তার হৃদয় ও তার রূহ। আর
তার ইলাহ আল্লাহ তা‘আলা ছাড়া তার কোনই কল্যাণ ও উপযোগিতা নেই, যে আল্লাহ ছাড়া
সত্যিকার আর কোন ইলাহও নেই। সুতরাং দুনিয়ায় আল্লাহকে স্মরণ করা ছাড়া তার সেই হৃদয়
ও রূহ প্রশান্ত হয় না। আর যদি আল্লাহ ছাড়া অন্য কিছু দ্বারা বান্দার আনন্দ ও উল্লাস অর্জিত হয় তবে তা স্থায়ী হয় না। বরং তা
একপ্রকার থেকে অন্য প্রকারে স্থানান্তরিত হয়ে যায়। এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির
দিকে স্থানান্তরিত হয়। কিন্তু তার যে প্রকৃত ইলাহ, তাকে অবশ্যই তার সাথে (অন্তরের
সম্পর্কে) সম্পৃক্ত থাকতে হয়, সর্বাবস্থায়, সব সময় ও যেখানেই সে থাকুক না কেন।’’[8]
এ প্রকারের তাওহীদ রাসূলগণের দাওয়াতের মূল বিষয়। কেননা
এই তাওহীদই হচ্ছে সে মূল ভিত্তি যার উপর সকল আমল স্থাপিত। এ প্রকার তাওহীদ
প্রতিষ্ঠিত না হলে কোন আমলই শুদ্ধ হয় না। কেননা এই প্রকারের তাওহীদ প্রতিষ্ঠিত না
হলে তাওহীদবিরোধী চিন্তাভাবনা থেকে যায়, যা কিনা শির্ক বলেই বিবেচিত। অথচ আল্লাহ
তা‘আলা বলেছেন,
﴿ إِنَّ ٱللَّهَ لَا يَغۡفِرُ أَن يُشۡرَكَ بِهِۦ ﴾ [النساء : ٤٨،١١٦]
‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করাকে ক্ষমা করেন না।’’[9]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿ وَلَوۡ أَشۡرَكُواْ لَحَبِطَ عَنۡهُم مَّا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ
٨٨ ﴾ [الانعام: ٨٨]
‘‘যদি তারা শির্ক করে তাহলে তারা যে সকল আমল করেছিল তা তাদের থেকে
নিষ্ফল হয়ে যাবে।’’[10]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿لَئِنۡ أَشۡرَكۡتَ لَيَحۡبَطَنَّ عَمَلُكَ وَلَتَكُونَنَّ مِنَ
ٱلۡخَٰسِرِينَ ٦٥ ﴾ [الزمر: ٦٤]
‘‘যদি তুমি শির্ক কর তাহলে অবশ্যই তোমার আমল নষ্ট হয়ে যাবে এবং
তুমি অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।’’[11]
এ ছাড়াও বান্দার উপর যে সকল বিধান সর্ব প্রথম আরোপিত হয়
এ প্রকার তাওহীদ তার অন্যতম। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ ۞وَٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ وَلَا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡٔٗاۖ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ
إِحۡسَٰنٗا ﴾ [النساء : ٣٦]
‘‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদাত করো এবং তাঁর সাথে কোন কিছুর শরীক করো
না আর পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করো।’’[12]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿ ۞وَقَضَىٰ رَبُّكَ أَلَّا تَعۡبُدُوٓاْ إِلَّآ إِيَّاهُ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ
إِحۡسَٰنًاۚ ﴾ [الاسراء: ٢٣]
‘‘তোমার প্রভূ এ নির্দেশ প্রদান করেছেন যে, তোমরা আল্লাহ ছাড়া আর
কারো ইবাদাত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সুন্দর ব্যবহার করবে।’’[13]
আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿ ۞قُلۡ تَعَالَوۡاْ أَتۡلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمۡ عَلَيۡكُمۡۖ
أَلَّا تُشۡرِكُواْ بِهِۦ شَيۡٔٗاۖ وَبِٱلۡوَٰلِدَيۡنِ إِحۡسَٰنٗاۖ ﴾ [الانعام: ١٥١]
‘‘বল, এসো তোমাদের রব তোমাদের উপর যা হারাম করেছেন আমি তোমাদের তা
পাঠ করে শোনাই। আর তা হল এই যে, তোমরা তাঁর সাথে কোন কিছু শরীক করবে না। আর
পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করবে।’’[14]
[6] সহীহ বুখারীর ২৫, ৩৯২, ১৩৯৯, ২৯৪৬ নং ও সহীহ মুসলিমের
১৩৩-১৩৮ নং হাদীস হিসাবে এটি বর্ণিত হয়েছে ।
[7] সূরা মুহাম্মাদ : ১৯
[8] মাজমু আল ফাতাওয়া: ১/২৪
[9] সূরা আন-নিসা: ৪৮, ১১৬
[10] সূরা আল-আন’আম: ৮৮
[11] সূরা আয-যুমার: ৬৫
[12] সূরা আন নিসা: ৩৬
[13] সূরা আল ইসরা: ২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন