রবিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১২

তাওহীদ পরিচিতি-5


তাওহীদ পরিচিতি-5
অনুবাদ: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
স্রষ্টার অস্তিত্ব ও তাঁর একত্ববাদ প্রমাণে
আল-কুরআনের নীতি

স্রষ্টার অস্তিত্ব ও তাঁর একত্ববাদ প্রমাণে আল-কুরআনের নীতি সঠিক ফিতরাত ও স্বভাব এবং সুস্থ বিবেকের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। আর এ নীতি বাস্তবায়িত হয়েছে এমন বিশুদ্ধ প্রমাণ উপস্থাপনের মাধ্যমে যদ্বারা বিবেক সম্পন্ন সকল মানুষ সন্তুষ্ট হয় এবং প্রতিপক্ষ তা মেনে নেয়। এ সকল বিশুদ্ধ প্রমাণের মধ্যে রয়েছে :

১. এটা সবারই জরুরী জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত যে, প্রত্যেক ঘটনার পেছনে অবশ্যই একজন ঘটনাসৃষ্টিকারী রয়েছে। এটি সর্বজনগ্রাহ্য ও জরুরীভাবে ফিতরাত দ্বারা অর্জিত জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত একটি বিষয়। এমনকি বিষয়টি শিশুদের কাছেও বোধগম্যকোন শিশুকে যদি কোন প্রহারকারী প্রহার করে এবং শিশুটি প্রহারকারীকে দেখতে না পায় তবে সে অবশ্যই প্রশ্ন করবে, কে আমাকে মেরেছে? যদি তাকে বলা হয় তোমাকে কেউই প্রহার করেনি তখন তার বিবেক একথা গ্রহণ করবে না যে, কোন ধরনের ঘটনা প্রবাহ সৃষ্টিকারী ছাড়াই প্রহারের ঘটনাটি ঘটেছে। যদি তাকে বলা হয়, অমুক তোমাকে মেরেছে, সে কাঁদতে থাকবে যতক্ষণ না তার প্রহারকারীকে প্রহার করা হয়। এজন্যই আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন
﴿ أَمۡ خُلِقُواْ مِنۡ غَيۡرِ شَيۡءٍ أَمۡ هُمُ ٱلۡخَٰلِقُونَ ٣٥ ﴾ [الطور: ٣٤] 
‘‘তাদেরকে কি সৃষ্টি করা হয়েছে কোন কিছু ছাড়াই, নাকি তারাই সৃষ্টিকারী?’’[1]

এটি একটি সুনির্দিষ্ট বন্টন যা আল্লাহ তা‘আলা অস্বীকৃতিজ্ঞাপক প্রশ্নবোধক শব্দের মাধ্যমে উল্লে­খ করেছেন একথা বর্ণনা করার জন্য যে, এ ভূমিকাটুকু অবশ্যম্ভাবীভাবে সর্বজনবিদিত, কারো পক্ষেই একে অস্বীকার করা সম্ভব নয়। তিনি বলেছেন, ‘‘তারা কি তাদেরকে সৃষ্টিকারী কোন স্রষ্টা ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে, নাকি তারাই নিজেদেরকে সৃষ্টি করেছে?’’ দু’টো বিষয়ের প্রত্যেকটিই বাতিল ও অশুদ্ধ। অতএব এটা নির্দিষ্ট হয়ে গেল যে, তাদের অবশ্যই এমন একজন স্রষ্টা রয়েছেন যিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। তিনি হচ্ছেন আল্লাহ সুবহানাহু। তিনি ছাড়া আর কোন স্রষ্টা নেই। তিনি বলেছেন,
﴿ هَٰذَا خَلۡقُ ٱللَّهِ فَأَرُونِي مَاذَا خَلَقَ ٱلَّذِينَ مِن دُونِهِۦۚ ﴾ [لقمان: ١١] 
‘‘এ হচ্ছে আল্লাহর সৃষ্টি। সুতরাং আমাকে দেখাও তিনি ছাড়া আর যেসব সত্ত্বা রয়েছে তারা কি সৃষ্টি করেছে?’’[2]
﴿ أَرُونِي مَاذَا خَلَقُواْ مِنَ ٱلۡأَرۡضِ ﴾ [الاحقاف: ٤]   
‘‘আমাকে দেখাও যে তারা যমীন থেকে কি সৃষ্টি করেছে?’’[3]
﴿أَمۡ جَعَلُواْ لِلَّهِ شُرَكَآءَ خَلَقُواْ كَخَلۡقِهِۦ فَتَشَٰبَهَ ٱلۡخَلۡقُ عَلَيۡهِمۡۚ قُلِ ٱللَّهُ خَٰلِقُ كُلِّ شَيۡءٖ وَهُوَ ٱلۡوَٰحِدُ ٱلۡقَهَّٰرُ ١٦ ﴾ [الرعد: ١٦]   
‘‘নাকি তারা আল্লাহর জন্য এমন সব শরীক স্থির করে রেখেছে যারা তাদেরকে সৃষ্টি করেছে যেভাবে তিনি সৃষ্টি করেন, ফলে তাদের কাছে উভয় সৃষ্টি এক রকম হয়ে গিয়েছে? বল, আল্লাহই সবকিছুর স্রষ্টা। তিনি একক, পরাক্রমশালী।’’[4]
﴿ إِنَّ ٱلَّذِينَ تَدۡعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ لَن يَخۡلُقُواْ ذُبَابٗا وَلَوِ ٱجۡتَمَعُواْ لَهُۥۖ ﴾ [الحج : ٧٣]   
‘‘নিশ্চয়ই যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্য কিছুকে আহ্বান করে, তারা সম্মিলিত হয়েও কখনোই একটি মাছিকেও সৃষ্টি করতে পারবে না।’’[5]
﴿ وَٱلَّذِينَ يَدۡعُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ لَا يَخۡلُقُونَ شَيۡ‍ٔٗا وَهُمۡ يُخۡلَقُونَ ٢٠ ﴾ [النحل: ٢٠]    
‘‘যারা আল্লাহর পরিবর্তে অন্য কিছুকে আহ্বান করে তারা কোন কিছুই সৃষ্টি করতে পারে না বরং তাদেরকেই সৃষ্টি করা হয়।’’[6]
﴿ أَفَمَن يَخۡلُقُ كَمَن لَّا يَخۡلُقُۚ أَفَلَا تَذَكَّرُونَ ١٧ ﴾ [النحل: ١٧]    
‘‘যিনি সৃষ্টি করেন তিনি কি ঐ বস্তুর ন্যায় যা সৃষ্টি করে না? তবু কি তোমরা উপদেশ গ্রহণ করছো না?’’[7]
বার বার দেয়া এ চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি কেউই এ দাবী করেনি যে, সে কোন কিছু সৃষ্টি করেছে। বরং কোন প্রমাণ সাব্যস্ত করা তো দূরে থাকুক, শুধুমাত্র এ দাবীর উত্থাপনও কেউ করেনি। ফলে এটা সুনির্দিষ্ট হয়ে গেল যে, মহান আল্লাহ সুবহানাহুই হচ্ছেন একমাত্র স্রষ্টা। তাঁর কোন শরীক নেই।

২. সারা জাহানের সুশৃঙ্খল ও সুদৃঢ় ব্যবস্থাপনা হল এ বিষয়ে সবচেয়ে বড় দলীল যে, এর পরিচালক একজন মাত্র ইলাহ, একজনই রব, যার কোন শরীক নেই, নেই কোন বিবাদীও। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿مَا ٱتَّخَذَ ٱللَّهُ مِن وَلَدٖ وَمَا كَانَ مَعَهُۥ مِنۡ إِلَٰهٍۚ إِذٗا لَّذَهَبَ كُلُّ إِلَٰهِۢ بِمَا خَلَقَ وَلَعَلَا بَعۡضُهُمۡ عَلَىٰ بَعۡضٖۚ ﴾ [المؤمنون : ٩١]   
‘‘আল্লাহ কোন সন্তান গ্রহণ করেন নি এবং তাঁর সাথে কোন অন্য ইলাহও নেই। যদি থাকত তবে প্রত্যেক ইলাহ স্বীয় সৃষ্টি নিয়ে পৃথক হয়ে যেত এবং একে অপরের উপর প্রাধান্য বিস্তার করত।’’[8]
        সুতরাং সত্যিকার ইলাহ এমন এক স্রষ্টা হওয়া বাঞ্ছনীয় যিনি হবেন কর্মবিধায়ক। যদি তাঁর সাথে আর কোন ইলাহ থেকে থাকে যিনি তাঁর রাজত্বে তাঁর সাথে শরীক - আল্লাহ তা থেকে পবিত্র ও মহান -, তাহলে অবশ্যই সে ইলাহেরও সৃষ্টিকাজ ও অন্যান্য কাজ থাকবে। যদি সত্যি এমন হয় তাহলে তাঁর সাথে অন্য ইলাহের শরীকানা তাঁকে খুশি করবে না বরং তিনি যদি তাঁর শরীককে নিয়ন্ত্রণ করতে সমর্থ হন এবং একাই রাজত্ব ও ইলাহিয়্যাতের মালিক হতে পারেন তবে তিনি তাই করবেন। আর যদি তা করতে অসমর্থ হন তাহলে তিনি রাজত্ব ও সৃষ্টিতে নিজের অংশ নিয়েই একাকী পড়ে থাকবেন যেভাবে দুনিয়ার বাদশাহরা নিজ নিজ রাজত্ব নিয়ে অন্যদের থেকে পৃথক হয়ে পড়ে আছেন। এমতাবস্থায় জগতে বিভক্তি দেখা দেবে। সুতরাং পুরো অবস্থাটি তিন অবস্থার একটি অবশ্যই হবে:
ক. হয় একজন অন্যজনের উপর বিজয়ী হবে এবং সকল মালিকানার অধিকারী হবে।
খ. অথবা তাদের প্রত্যেকেই একে অন্য থেকে পৃথক হয়ে নিজ নিজ রাজত্ব ও সৃষ্টি নিয়ে থাকবে ফলে জগত বিভক্ত হবে।
গ. অথবা তাদের উভয়ে একজন মালিকের অধীনস্থ থাকবে যিনি তাদের ব্যাপারে যা ইচ্ছা তাই করবেন। তিনিই হবেন প্রকৃত ইলাহ এবং তারা হবে তাঁর বান্দা।

এ শেষোক্ত কথাটিই হচ্ছে মূল বাস্তবতা। কেননা জগতে কোন বিভক্তি নেই এবং কোন ত্রুটিও নেই। এ দ্বারা প্রমাণিত হয় জগতের পরিচালনাকারী একজনই এবং তাঁর কোন বিবাদী নেই এবং তিনিই একমাত্র মালিক, তাঁর কোন শরীক নেই।

৩. সৃষ্টিজগতকে তার দায়িত্ব আদায় ও কর্তব্য পালনে অনুগত রাখা।
এ জগতে এমন কোন সৃষ্ট বস্তু নেই যা তার দায়িত্ব পালনকে অস্বীকার করে ও তা থেকে বিরত থাকে। মূসা আলাইহিস সাল্লাম এ বিষয়টি দিয়েই প্রমাণ পেশ করেছিলেন যখন ফেরআউন তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ﴿ قَالَ فَمَن رَّبُّكُمَا يَٰمُوسَىٰ ٤٩ ﴾ [طه: ٤٩]  ‘‘ফেরআউন বলল, হে মূসা! তোমাদের রব কে?’’[9] মূসা আলাইহিস সাল্লাম একটি পরিপূর্ণ জবাব দিয়ে বলেছিলেন,
﴿ رَبُّنَا ٱلَّذِيٓ أَعۡطَىٰ كُلَّ شَيۡءٍ خَلۡقَهُۥ ثُمَّ هَدَىٰ ٥٠ ﴾ [طه: ٥٠]
  ‘আমাদের রব হচ্ছেন সেই সত্ত্বা যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। অত:পর তাকে হেদায়াত দিয়েছেন।’’[10]
এর অর্থ হচ্ছে আমাদের প্রভূ হচ্ছেন সেই সত্ত্বা যিনি সকল সৃষ্টিজগতকে সৃষ্টি করেছেন এবং প্রত্যেক সৃষ্ট বস্তুকে তার উপযুক্ত অবয়ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, চাই সেটা দেহের বড়ত্ব-ছোটত্ব বা মধ্যম অবয়ব হোক ও অন্যান্য গুণাবলী সংক্রান্তই হোক। অত:পর প্রত্যেক সৃষ্টিকে যে জন্য সৃষ্টি করেছেন সে দিকে হিদায়াত দিয়েছেন। আর এ হিদায়াত হচ্ছে পথনির্দেশমূলক ও জ্ঞানগত হিদায়াত। আর এ হিদায়াতই সমস্ত মাখলুকাতের মধ্যে পরিপূর্ণভাবে দেখা যায়। অতএব প্রত্যেক মাখলুক সেজন্যই চেষ্টা করে যে কল্যাণের জন্য তাকে সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তার থেকে যাবতীয় অনিষ্ট প্রতিরোধের জন্য চেষ্টা করে থাকে। এমনকি আল্লাহ  জীবজন্তুকেও উপলব্ধি ও অনুভূতি শক্তি দান করেছেন যা দ্বারা সে নিজের উপকারী কাজ করতে সক্ষম হয় এবং তার জন্য যা ক্ষতিকর তা প্রতিরোধ করতে সমর্থ হয়। আর যা দ্বারা সে তার জীবনে প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারে। যেমন আল্লাহ  বলেন,
﴿ ٱلَّذِيٓ أَحۡسَنَ كُلَّ شَيۡءٍ خَلَقَهُۥۖ ﴾ [السجدة : ٧]
 ‘‘যিনি সবকিছুকে সুন্দর অবয়ব দিয়ে সৃষ্টি করেছেন।’’[11]
সুতরাং যিনি সমস্ত মাখলুকাতকে সৃষ্টি করেছেন এবং এ সকল সৃষ্টিকে সুন্দর অবয়ব দান করেছেন যে সুন্দর অবয়বের উপর বিবেক কোন আপত্তি উপস্থাপন করতে পারে না। আর এসব কিছুকেই তাদের কল্যাণের দিকে পথ প্রদর্শন করেছেন। তিনিই হচ্ছেন প্রকৃত রব। তাকে অস্বীকার করার অর্থই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বাস্তব ও সবচেয়ে বড় সত্ত্বাকে অস্বীকার করা। আর এটি হচ্ছে বড় ধরনের অহংকার ও স্পষ্ট মিথ্যাবাদিতা। আল্লাহ তা‘আলা সৃষ্টির সকলকে সবকিছু দান করেছেন, দুনিয়ায় যার প্রয়োজন তাদের রয়েছে। তারপর তাদেরকে সে সব বস্তু দ্বারা কল্যাণ অর্জনের পদ্ধতি শিখিয়েছেন। কোন সন্দেহ নেই যে, তিনি সকল প্রকার বস্তুকে তার উপযোগী আকৃতি ও অবয়ব দান করেছেন, পারস্পরিক বিবাহ-মিলন ও ভালবাসায় প্রত্যেক জাতের নর-নারীকে তার উপযুক্ত আকৃতি দান করেছেন। আর প্রত্যেক অঙ্গকে তার উপর অর্পিত কাজের উপযোগী আকৃতি প্রদান করেছেন। এসবকিছুর মধ্যেই সুস্পষ্ট, সুদৃঢ় ও সন্দেহমুক্ত এ প্রমাণ রয়েছে যে, মহান আল্লাহ তা‘আলাই সবকিছুর রব। তিনিই একমাত্র ইবাদাতের অধিকারী, অন্য কিছু নয়। কবি বলেন,
সবকিছুর মধ্যেই রয়েছে তাঁর একটি নিদর্শন
যা প্রমাণ করে যে তিনি এক
আর এতে কোন সন্দেহ নেই যে, সৃষ্টিকাজে মহান আল্লাহ সুবহানাহুর একক রুবুবিয়্যাত প্রমাণ দ্বারা উদ্দেশ্য হল, একমাত্র আল্লাহ তাআলার ইবাদাত ওয়াজিব হওয়ার উপর প্রমাণ পেশ করা, যার কোন শরীক নেই। একে বলা হয় তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ। সুতরাং কোন মানুষ যদি তাওহীদুর রুবুবিয়্যার প্রতি স্বীকৃতি জ্ঞাপন করে কিন্তু তাওহীদুল উলুহিয়্যাহকে সে অস্বীকার করে অথবা সঠিক ও বিশুদ্ধ পন্থায় তাওহীদুল উলুহিয়্যার স্বীকৃতি আদায় না করে, তবে সে মুসলিম হবে না এবং সে তাওহীদপন্থী বলেও স্বীকৃতি পাবে না বরং সে বিবেচিত হবে অস্বীকারকারী কাফিররূপে। ইনশাআল্লাহ পরবর্তী পরিচ্ছেদে আমরা এ সম্পর্কেই আলোচনা করব।


[1] সূরা আত-তূর:৩৫
[2] সূরা লুকমান: ১১
[3] সূরা আল-আহ্কাফ: ৪
[4] সূরা আর-রা‘দ: ১৬
[5] সূরা আল-হজ: ৭৩
[6] সূরা আন-নাহল: ২০
[7] সূরা আন-নাহল: ১৭
[8] সূরা আল-মু’মিনুন: ৯১
[9] সূরা ত্ব-হা: ৪৯
[10] সূরা ত্ব-হা: ৫০
[11] সূরা আস-সাজদা: ৭

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন