রবিবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১২

তাওহীদ পরিচিতি-12(তাওহীদুল আসমা ওয়াস-সিফাত)


তাওহীদ পরিচিতি-12
অনুবাদ: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
তৃতীয়তঃ তাওহীদুল আসমা ওয়াস-সিফাত

এতে রয়েছে নিম্নলিখিত বিষয়গুলো:

প্রথমত: আল্লাহর নামসমূহ ও সিফাত নির্ধারণে কুরআন, সুন্নাহ্ ও বিবেকের দলীল

দ্বিতীয়ত: আল্লাহর নাম ও সিফাতের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অনুসৃত নীতি

তৃতীয়ত: যারা আল্লাহর নাম ও সিফাতকে অস্বীকার করে অথবা এর কিয়দংশ অস্বীকার করে তাদের জবাব


প্রথমত: আল্লাহর নামসমূহ ও সিফাত নির্ধারণে
কুরআন, সুন্নাহ্ ও বিবেকের দলীল

[ক] কুরআন ও সুন্নাহর দলীল
ইতঃপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি যে, তাওহীদ তিনভাগে বিভক্ত : তাওহীদুর রুবুবিয়্যাহ, তাওহীদুল উলুহিয়্যাহ, তাওহীদুল আসমা ওয়াস-সিফাত। আমরা প্রথম দুটির উপর বেশ কিছু প্রমাণ উল্লে­খ করেছি। এখন আমরা তৃতীয় প্রকার তাওহীদুল আসমা ওয়াস-সিফাতের উপর কিছু দলীল পেশ করব।

১. আল-কুরআনের দলীলের মধ্যে রয়েছে:
﴿وَلِلَّهِ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ فَٱدۡعُوهُ بِهَاۖ وَذَرُواْ ٱلَّذِينَ يُلۡحِدُونَ فِيٓ أَسۡمَٰٓئِهِۦۚ سَيُجۡزَوۡنَ مَا كَانُواْ يَعۡمَلُونَ ١٨٠﴾ [الاعراف: 180]   
‘‘আর আল্লাহর রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম তোমরা সে নামে তাঁকে আহ্বান করো। আর সেসব লোকদের তোমরা পরিত্যাগ করো যারা তাঁর নামসমূহে বিকৃতি সাধন করে। তারা যা করত অচিরেই তাদেরকে তার প্রতিদান দেয়া হবে।’’[1]
এ আয়াতটিতে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা নিজের জন্য অনেকগুলো নাম সাব্যস্ত করেছেন এবং জানিয়েছেন যে, সেগুলো সুন্দরতম। তিনি তাঁকে সে নামসমূহে ডাকার নির্দেশ প্রদান করেছেন। যেমন এভাবে তাঁকে ডাকা হবে যে, ‘ইয়া আল্লাহ ! ইয়া রাহমান! ইয়া রাহীম! ইয়া হাইয়্যূ! ইয়া কাইয়্যুম! ইয়া রাববাল আলামীন!’ আর যারা তাঁর নামে বিকৃতি সাধন করে তাদেরকে তিনি ভয় প্রদর্শন করেছেন। অর্থাৎ যারা তাঁর নামের ব্যাপারে সত্যকে পাশ কাটিয়ে চলে, আল্লাহ থেকে সে নামগুলোকে অস্বীকার করার মাধ্যমে অথবা তার যে শুদ্ধ অর্থ রয়েছে সে শুদ্ধ অর্থ ব্যতীত অন্য অর্থে সেগুলোকে প্রয়োগ করার মাধ্যমে কিংবা অন্য আরো যেভাবে তা বিকৃত করা যায় সেভাবে বিকৃত করার মাধ্যমে; তাদেরকে তিনি এ মর্মে ভয় প্রদর্শন করেছেন যে, তাদের এ মন্দ কর্মের প্রতিফল তিনি অচিরেই তাদেরকে প্রদান করবেন। আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
﴿ ٱللَّهُ لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَۖ لَهُ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰ ٨ ﴾ [طه: ٨]   
‘‘আল্লাহ  ছাড়া প্রকৃত কোন ইলাহ নেই। তাঁর রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম।’’[2]
তিনি আরো বলেছেন,
﴿ هُوَ ٱللَّهُ ٱلَّذِي لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَۖ عَٰلِمُ ٱلۡغَيۡبِ وَٱلشَّهَٰدَةِۖ هُوَ ٱلرَّحۡمَٰنُ ٱلرَّحِيمُ ٢٢ هُوَ ٱللَّهُ ٱلَّذِي لَآ إِلَٰهَ إِلَّا هُوَ ٱلۡمَلِكُ ٱلۡقُدُّوسُ ٱلسَّلَٰمُ ٱلۡمُؤۡمِنُ ٱلۡمُهَيۡمِنُ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡجَبَّارُ ٱلۡمُتَكَبِّرُۚ سُبۡحَٰنَ ٱللَّهِ عَمَّا يُشۡرِكُونَ ٢٣ هُوَ ٱللَّهُ ٱلۡخَٰلِقُ ٱلۡبَارِئُ ٱلۡمُصَوِّرُۖ لَهُ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰۚ يُسَبِّحُ لَهُۥ مَا فِي ٱلسَّمَٰوَٰتِ وَٱلۡأَرۡضِۖ وَهُوَ ٱلۡعَزِيزُ ٱلۡحَكِيمُ ٢٤ ﴾ [الحشر: ٢٢،  ٢٤]   
‘‘তিনি আল্লাহ। তিনি ব্যতীত প্রকৃত কোন ইলাহ নেই। তিনি গায়েব ও দৃশ্যমান সবকিছুর ব্যাপারে জ্ঞান রাখেন। তিনি দয়াময়, পরম দয়ালু। তিনি আল্লাহ। তিনি ব্যতীত প্রকৃত কোন ইলাহ নেই। তিনি মালিক, তিনি পবিত্র, তিনি শান্তি, তিনি নিরাপত্তাবিধায়ক, তিনি পরাক্রমশালী, তিনি প্রবল, তিনি অতি মহিমান্বিত, তারা যাকে শরীক স্থির করে আল্লাহ তা হতে পবিত্র ও মহান। তিনি আল্লাহ সৃষ্টিকর্তা, উদ্ভাবনকর্তা, অবয়বদানকারী। তাঁর রয়েছে সকল উত্তম নাম। আকশমণ্ডলী ও পৃথিবীতে যা কিছু আছে সকলি তাঁরই পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়।’’[3]
এ আয়াতগুলো আল্লাহর নামসমূহকে সাব্যস্ত করে।
[২] রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নায় আল্লাহর নামসমূহ সাব্যস্ত করার ব্যাপারে অনেকগুলো দলীল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটি হল আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«إِنَّ لِلَّهِ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ اسْمًا مِائَةً إِلَّا وَاحِدًا مَنْ أَحْصَاهَا دَخَلَ الْجَنَّةَ»
‘‘আল্লাহর রয়েছে নিরানব্বইটি নাম, একটি ছাড়া একশতটি। যে ব্যক্তি এগুলো যথাযথভাবে কাজে লাগাল, সে জান্নাতে প্রবেশ করল।’’[4]
আল্লাহর নামসমূহ এ সংখ্যায় সীমাবদ্ধ নয়। এর প্রমাণ হল - আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
«أَسْأَلُكَ بِكُلِّ اسْمٍ هُوَ لَكَ سَمَّيْتَ بِهِ نَفْسَكَ أَوْ أَنْزَلْتَهُ فِي كِتَابِكَ أَوْ عَلَّمْتَهُ أَحَدًا مِنْ خَلْقِكَ أَوْ اسْتَأْثَرْتَ بِهِ فِي عِلْمِ الْغَيْبِ عِنْدَكَ أَنْ تَجْعَلَ الْقُرْآنَ رَبِيعَ قَلْبِي»
‘‘আমি আপনার কাছে আপনার সে সব নামের উসিলায় দোআ করছি যেসব নাম আপনার রয়েছে, যে নামে আপনি নিজেকে নামকরণ করেছেন অথবা যে নাম আপনি আপনার গ্রন্থে নাযিল করেছেন অথবা আপনার সৃষ্টির কাউকে আপনি শিক্ষা দিয়েছেন কিংবা আপনার কাছে যে গায়েবী ইলম রয়েছে তাতে আপনি যে নাম রেখে দিয়েছেন সেগুলোর উসিলায় আমি প্রার্থনা করছি যে, আপনি মহান আল-কুরআনকে আমার হৃদয়ের প্রিয় বসন্ত করে দিন।’’[5]
আল্লাহর নামসমূহের প্রত্যেকটি নামই তাঁর যে কোন একটি সিফাতকে শামিল করে। অতএব ‘আল-‘আলীম’ এ নামটি ‘ইলম’ গুণের প্রমাণ বহন করছে। ‘আল-হাকিম’ নামটি হিকমতের প্রমাণ বহন করছে। ‘আস-সামি‘উ’ ও ‘আল-বাছিরু’ এ দুটো নাম প্রমাণ বহন করছে শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তির উপর। এভাবে প্রত্যেকটি নাম আল্লাহর একেকটি সিফাত বা গুণের প্রমাণ বহন করছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ قُلۡ هُوَ ٱللَّهُ أَحَدٌ ١ ٱللَّهُ ٱلصَّمَدُ ٢ لَمۡ يَلِدۡ وَلَمۡ يُولَدۡ ٣ وَلَمۡ يَكُن لَّهُۥ كُفُوًا أَحَدُۢ ٤  ﴾ [الاخلاص: ١،  ٥]   
‘‘বল, তিনি আল্লাহ একক। আল্লাহ অমুখাপেক্ষী। তাঁর কোন সন্তান নেই, তিনিও কারো সন্তান নন। কেউই তাঁর সমকক্ষ নয়।’’[6]
আনাস রাদিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আনসারের এক লোক মসজিদে কুবায় ইমামতি করছিল। যখনি সে কোন সূরা দিয়ে সালাত শুরু করত তখনি সে ‘কুল-হু আল্লাহু আহাদ’ সূরাটি পাঠ করত। এটি পাঠ শেষ করার পর সে এর সাথে আরেকটি সূরা মিলাত। সে প্রত্যেক রাক‘আতেই এরকম করত। তখন তার সাথীরা এ ব্যাপারে তার সাথে কথা বলল। তারা বলল, তুমি এই সূরা দিয়ে সালাত শুরু করো এরপর অন্য একটি সূরা মিলাও কারণ তোমার কাছে হয়ত এই সূরাটি যথেষ্ট নয়। সুতরাং হয় তুমি এ সূরা দিয়ে পাঠ করবে অথবা এ সূরা ছেড়ে অন্য সূরা পাঠ করবে। তখন সে ব্যক্তি বললেন, ‘আমি সূরা ইখলাস ত্যাগ করতে পারবো না। যদি তোমরা চাও তাহলে আমি তোমাদের এভাবেই ইমামতি করব। আর যদি তোমরা অপছন্দ করো তাহলে আমি তোমাদেরকে ছেড়ে যাবো।’ তাদের অভিমত ছিল সে ব্যক্তি তাদের মধ্যে সর্বোত্তম ব্যক্তি এবং তাদের অপছন্দ ছিল যে, তিনি ছাড়া আর কেউ ইমামতি করবেন। যখন তাদের কাছে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আসলেন তখন তারা তাঁকে সংবাদটি দিলেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, ‘‘হে অমুক! তোমাকে তোমার বন্ধুরা যে নির্দেশ প্রদান করছে তা পালন করতে কিসে তোমাকে নিষেধ করছে? আর প্রত্যেক রাক‘আতেই এ সূরা নিয়মিত পাঠে কিসে তোমাকে উদ্বুদ্ধ করছে?’’ তখন তিনি বললেন, ‘আমি এ সূরাটিকে ভালবাসি।’ তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে বললেন, ‘‘এ সূরার প্রতি ভালবাসা তোমাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবে।’’[7]

আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এক ব্যক্তিকে একটি ছোট সৈন্য দলে প্রেরণ করলেন। সে ব্যক্তি তার সাথীদের নিয়ে সালাতের ইমামতি করত এবং সে ‘কুল-হু আল্লাহ’ দিয়ে সালাত শেষ করত। যখন তারা ফিরে আসল তখন তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বিষয়টি উল্লে­খ করলে তিনি বললেন, ‘‘তাকে জিজ্ঞেস করো কেন সে এ কাজটি করত?’’ তারা তাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, কেননা এ সূরাটি হচ্ছে আল্লাহর গুণ, তাই আমি এ সূরাটি দিয়ে পড়তে ভালবাসি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘‘তাকে এ সংবাদ দাও যে, আল্লাহ  তাআলা তাকে ভালবাসেন।’’[8] অর্থাৎ সূরাটি আল্লাহর গুণাবলীকে শামিল করছে।

আল্লাহ তা‘আলা এ সংবাদও দিয়েছেন যে, তাঁর মুখমণ্ডল রয়েছে। তিনি বলেন,
﴿ وَيَبۡقَىٰ وَجۡهُ رَبِّكَ ذُو ٱلۡجَلَٰلِ وَٱلۡإِكۡرَامِ ٢٧ ﴾ [الرحمن: ٢٧]   
‘‘আর আপনার প্রভূর চেহারা সত্ত্বাসহ স্থায়ী থাকবেন যিনি সম্মানিত।’’[9]
এ সংবাদও দিয়েছেন যে, তাঁর দু’টো হাত রয়েছে। তিনি বলেছেন,  ﴿ لِمَا خَلَقۡتُ بِيَدَيَّۖ ﴾ [ص : ٧٥]    ‘‘আমার দু’হাত দিয়ে আমি যা সৃষ্টি করেছি।’’[10]  ﴿بَلۡ يَدَاهُ مَبۡسُوطَتَانِ ‘‘বরং তাঁর দুই হস্ত প্রসারিত।’’[11]
তিনি এ সংবাদও দিয়েছেন যে, তিনি সন্তুষ্ট হন, তিনি ভালবাসেন, তিনি ক্রোধান্বিত হন, তিনি রাগান্বিত হন ইত্যাদি আরো অনেক গুণাবলী রয়েছে যেগুলো দিয়ে আল্লাহ নিজেকে বর্ণনা করেছেন অথবা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ব্যাপারে বর্ণনা করেছেন। আর আল্লাহর যে সকল নাম ও গুণাবলী সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে শরী‘আতের দলীল রয়েছে সেগুলোর উপর বিবেকের নিম্নলিখিত দলীলও প্রমাণ বহন করছে :
[১]  বিভিন্ন প্রকার, নানা পার্থক্য ও নিজ নিজ কর্তব্য আদায়ে নিজস্ব শৃঙ্খলা নিয়ে এই যে বিশাল সৃষ্টিজগত রয়েছে এবং তাদের জন্য দেয়া নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা চলছে সেসব কিছুই মহান আল্লাহর মহত্ত্ব, সামর্থ, কুদরত ও তাঁর জ্ঞান-হিকমত-ইচ্ছার উপর প্রমাণ বহন করছে।
[২]  ইহসান এবং দয়া প্রদর্শন, ক্ষতি অপসারণ, বিপদ থেকে উদ্ধার এ সকল কিছুই আল্লাহর রহমত, দয়া, করুণা ও মহত্ত্বের প্রমাণ বহন করছে।
[৩] পাপীদের শাস্তি এবং তাদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ, তাদের প্রতি আল্লাহর ক্রোধ ও আল্লাহর ঘৃণার প্রমাণ বহন করছে।
[৪] আর অনুগত লোকদের সম্মানিত করা এবং তাদের পুরস্কৃত করা তাদের প্রতি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালবাসার প্রমাণ বহন করছে।


দ্বিতীয়ত: আল্লাহর নাম ও সিফাতসমূহের ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নীতি

পূর্ববর্তী আলেমগণ ও তাদের অনুসারী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নীতি হচ্ছে আল্লাহর নামসমূহ ও তাঁর গুণাবলী আল-কুরআন ও সুন্নায় যেভাবে এসেছে সেভাবে সাব্যস্ত করা। তাদের নীতি গুলো নিম্ন বর্ণিত নিয়মের উপরে স্থাপিত:
[১] তারা আল-কুরআন ও সুন্নায় আল্লাহর নামসমূহ ও গুণাবলী যেভাবে এসেছে সেভাবেই সাব্যসত্ম করে থাকেন এবং এ নাম ও গুণাবলীর শব্দসমূহ যে অর্থ প্রদান করছে তাও তারা সাব্যস্ত করে থাকেন। তারা এ নাম ও গুণাবলীর প্রকাশ্য অর্থ থেকে এগুলোকে পৃথক করেন না। এসব শব্দ ও অর্থকে তার স্থান থেকে পরিবর্তনও করেন না।
[২] তারা এ নাম ও গুণাবলীগুলোর সাথে মাখলুকের গুণাবলীর তুলনীয় হওয়াকে অস্বীকার করেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١ ﴾ [الشورى: ١١]   
‘‘তাঁর মত কোন কিছুই নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা’’[12]
[৩] আল্লাহ তাআলার নামসমূহ ও গুণাবলী সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে তারা আল-কুরআন ও সুন্নায় যা এসেছে তা অতিক্রম করে অন্য কোন বক্তব্য পেশ করেন না। সুতরাং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যে নাম ও গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন তারা তা সাব্যস্ত করেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা অস্বীকার করেছেন তারা তা অস্বীকার করেন। আর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আল্লাহ সম্পর্কে যে বিষয়ে চুপ ছিলেন তারাও সে বিষযে চুপ থেকেছেন।
[৪] তারা বিশ্বাস করেন যে, আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সংক্রান্ত যে বক্তব্য কুরআনে এবং সুন্নায় এসেছে তা মুহকাম বা সুদৃঢ় বক্তব্যের অন্তর্ভুক্ত, যার অর্থ বোধগম্য এবং যার ব্যাখ্যা প্রদান করা যায় এবং তা অবোধগম্য মুতাশাবিহ আয়াতসমূহের অন্তর্ভুক্ত নয়। সুতরাং বোধগম্য নয় এ যুক্তিতে তারা সেসব নাম ও সিফাতের অর্থ আল্লাহর প্রতি অর্পণ করে না; যেমন তাদের প্রতি মিথ্যারোপকারী একদল লোক তাদেরকে অপবাদ দিয়ে থাকে, অথবা তাদের নীতিমালা জানা না থাকার কারণে সমকালীন কতিপয় লেখক বা গ্রন্থকার তাদের প্রতি যে কটাক্ষ করে থাকে।
[৫] তারা আল্লাহ তাআলার গুণাবলীর কাইফিয়াত তথা অবয়ব বা ধরণ আল্লাহর কাছেই অর্পণ করে থাকেন এবং এ ব্যাপারে তারা কোন চিন্তা-গবেষণা করে না।


তৃতীয়ত: যারা আল্লাহর নাম ও সিফাতকে অস্বীকার করে অথবা এর কিয়দংশ অস্বীকার করে
তাদের কথার অপনোদন।
এ ধরনের লোক তিন ভাগে বিভক্ত।
[১] জাহমিয়া: তারা হচ্ছে জাহম ইবনে সাফওয়ান এর অনুসারী। এরা আল্লাহর সকল নাম এবং সিফাতকে অস্বীকার করে।
[২] মু‘তাযিলা: তারা ওয়াসিল বিন ‘আতা এর অনুসারী যিনি হাসান আল-বাসরীর বৈঠক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। এরা আল্লাহর নাম সাব্যস্ত করে এ বিশ্বাসের ভিত্তিতে যে, এগুলো যাবতীয় অর্থ থেকে মুক্ত শব্দমালা মাত্র। আর তারা আল্লাহর সকল গুণাবলীকে অস্বীকার করে।
[৩] আশা‘ইরাহ ও মাতুরিদিয়্যাহ এবং তাদের অনুসারীবৃন্দ : এরা আল্লাহর সকল নাম এবং কিছু সিফাতকে সাব্যস্ত করে আর বাকীগুলোকে অস্বীকার করে। যে সংশয়ের উপর ভিত্তি করে তারা তাদের মতবাদকে দাঁড় করিয়েছে তা হচ্ছে, তাদের ধারণা অনুযায়ী এ সমস্ত সিফাত সাব্যস্ত করলে আল্লাহর সৃষ্টির সাথে আল্লাহর নিজেরই তুলনা হয়ে পড়ে। ফলে তা থেকে আমাদের সরে যাওয়া উচিত; কেননা মাখলুকের অনেককেই আল্লাহর সে সমস্ত নাম দ্বারাও নামকরণ করা হয় এবং আল্লাহর সে সমস্ত সিফাত বা গুণাবলী দ্বারাও তাদের গুণ বর্ণনা করা হয়। এর ফলে তাদের ধারণা অনুযায়ী নাম এবং সিফাতের শব্দ ও অর্থের মধ্যে উভয়ের একটি তুলনা ও অংশীদারিত্ব সৃষ্টি হওয়ার কারণে তাদের হাকীকত তথা মূল অর্থের মধ্যে তুলনা ও অংশীদারিত্ব অপরিহার্য্য হয়ে পড়ে। এতে তাদের দৃষ্টিতে খালেকের সাথে মাখলুকের তুলনাও অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ে। ফলে এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য তারা দু’টোর যে কোন একটি পথ অবলম্বন করেছে-
এক : তারা এ সকল নাম ও গুণাবলীর ব্যাপারে কুরআন ও হাদিসের যে বক্তব্য রয়েছে, সেগুলোকে তাদের প্রকাশ্য অর্থ থেকে তা’বিল বা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করে; যেমন তারা ওয়াজহ্ বা মুখমণ্ডলকে তা’বিল বা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করে আল্লাহর জাত বা সত্ত্বা দ্বারা, ইয়াদকে তা’বিল করে নিয়ামত দ্বারা।
দুই : তারা নাম ও সিফাত সম্পর্কিত কুরআন ও হাদিসের বক্তব্যগুলোকে আল্লাহর প্রতি সমর্পণ করে এবং বলে যে, এগুলো দ্বারা কি উদ্দেশ্য আল্লাহই ভাল জানেন, আমাদের বোধগম্য নয়। আর এ আকীদা তারা পোষণ করে যে, এ নাম এবং গুণাবলী সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসের বক্তব্যসমূহ দ্বারা প্রকাশ্য অর্থ  বুঝানো হয় নি[13]
আল্লাহর নাম এবং সিফাত যারা প্রথম অস্বীকার করেছে বলে জানা গেছে, তারা হচ্ছে আরবের কতিপয় মুশরিক। আল্লাহ যাদের ব্যাপারে এ বাণী নাযিল করেছিলেন,
﴿ كَذَٰلِكَ أَرۡسَلۡنَٰكَ فِيٓ أُمَّةٖ قَدۡ خَلَتۡ مِن قَبۡلِهَآ أُمَمٞ لِّتَتۡلُوَاْ عَلَيۡهِمُ ٱلَّذِيٓ أَوۡحَيۡنَآ إِلَيۡكَ وَهُمۡ يَكۡفُرُونَ بِٱلرَّحۡمَٰنِۚ ﴾ [الرعد: ٣٠]   
‘‘অনুরূপভাবে তোমাকে পাঠিয়েছি এমন এক জাতির মধ্যে যার পূর্বে আরো বহু জাতি অতিবাহিত হয়ে গেছে, যেন আমি তোমার কাছে যা ওহীরূপে প্রেরণ করেছি তা তুমি তাদের কাছে তিলাওয়াত কর। অথচ তারা রহমানের প্রতি কুফরী ও অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে।’’[14]
        এ আয়াতের শানে নযুল হচ্ছে, কুরাইশরা যখন শুনতে পেল যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ‘আর-রাহমান’ নামটি উল্লেখ করছেন তখন তারা তা অস্বীকার করল। আল্লাহ তখন তাদের ব্যাপারে নাযিল করলেন ﴿وَهُمۡ يَكۡفُرُونَ بِٱلرَّحۡمَٰنِۚ ‘‘তারা রাহমানের প্রতি কুফরী ও অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করছে’’। ইবনে জারির বলেন যে, এটি ছিল হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এবং তাদের মধ্যকার সন্ধির বিষয়ে লেখক লিখছিল, ‘‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’’। তখন কুরাইশরা বলেছিল, ‘রাহমান’ নামটি তো আমাদের জানা নেই।
ইবনে জারির ইবনে আববাস থেকে আরো বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সিজদারত অবস্থায় দোআ করার সময় বলছিলেন, ইয়া রাহমান! ইয়া রাহীম! তখন মুশরিকরা বলল, এ ব্যক্তি ধারণা করে যে, সে এক সত্ত্বাকে আহ্বান করে অথচ সে তো দু’জনকে আহ্বান করছে। তখন নাযিল হল,
﴿قُلِ ٱدۡعُواْ ٱللَّهَ أَوِ ٱدۡعُواْ ٱلرَّحۡمَٰنَۖ أَيّٗا مَّا تَدۡعُواْ فَلَهُ ٱلۡأَسۡمَآءُ ٱلۡحُسۡنَىٰۚ ﴾ [الاسراء: ١١٠]   
‘‘আপনি বলুন যে, তোমরা আল্লাহকে আহ্বান করো বা রাহমানকে আহ্বান করো, যাকেই তোমরা আহ্বান করো না কেন তার তো রয়েছে সুন্দর সুন্দর নাম।’’[15]
আল্লাহ তা‘আলা সূরা ফুরকানের মধ্যে বলেছেন,
﴿ وَإِذَا قِيلَ لَهُمُ ٱسۡجُدُواْۤ لِلرَّحۡمَٰنِ قَالُواْ وَمَا ٱلرَّحۡمَٰنُ ﴾ [الفرقان: ٦٠]   
‘‘যখন তাদেরকে বলা হয় তোমরা রাহমানের উদ্দেশ্যে সিজদাবনত হও তখন তারা বলে রাহমান কে?’’[16]
এ মুশরিক ব্যক্তিরাই হচ্ছে জাহমিয়া, মু‘তাযিলা, আশা‘ইরা এমন প্রত্যেক অস্বীকারকারীর পূর্বসুরী, যারা আল্লাহর সে সব নাম ও গুণাবলীকে অস্বীকার করে যে সব নাম তিনি নিজেই সাব্যস্ত করেছেন অথবা তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জন্য সাব্যস্ত করেছেন।
আর তারা (মুশরিকরা) খারাপ উত্তরসুরীর জন্য কতই না খারাপ পূর্বসুরী।

        আল্লাহর নাম ও গুণাবলী সম্পর্কে এ ভ্রান্ত দলগুলোর বিরুদ্ধে কয়েকভাবে জওয়াব দেয়া যেতে পারে।
প্রথম জওয়াব: আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা তাঁর নিজের জন্য অনেকগুলো নাম ও গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন এবং তাঁর জন্য তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও সেসব নাম ও গুণাবলী সাব্যস্ত করেছেন। সুতরাং সেগুলো বা তার কিয়দংশকে অস্বীকার করা আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা সাব্যস্ত করেছেন তা অস্বীকার করারই শামিল। আর এ কাজটি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধাচারণ করারই নামান্তর।

দ্বিতীয় জবাব: মাখলুকের মধ্যে এ গুণাবলীর অস্তিত্ব থাকার কারণে কিংবা মাখলুকের কেউ কেউ এসব নামের কোন কোনটি দ্বারা নাম রাখার কারণে আল্লাহ ও তাঁর সৃষ্টির মধ্যে সাদৃশ্য হওয়া মোটেই অপরিহার্য হয় না; কেননা আল্লাহর রয়েছে এমন সব নাম ও গুণাবলী যা তাঁর জন্যই নির্দিষ্ট। আর মাখলুকেরও রয়েছে এমন নাম ও গুণাবলী যা তাদের জন্য নির্দিষ্ট। যেমন আল্লাহর এমন এক সত্ত্বা রয়েছে যা মাখলুকের সত্ত্বার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। সুতরাং তাঁর যেসব নাম ও গুণাবলী রয়েছে তাও মাখলুকের নাম ও গুণাবলীর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ নয়। নাম এবং সাধারণ অর্থের মধ্যে মিলিত হওয়ার দ্বারা এগুলোর মূল প্রকৃতিতে মিলিত হওয়াকে অপরিহার্য করে না। আল্লাহ নিজেই নিজের নাম দিয়েছেন ‘আল- ‘আলীম’ ও ‘আল-হালীম’। অথচ তিনি তাঁর কোন কোন বান্দাকে ‘আলীম’ নামে অভিহিত করেছেন যেমন তিনি বলেছেন,
﴿ وَبَشَّرُوهُ بِغُلَٰمٍ عَلِيمٖ ٢٨ ‘‘আর তারা তাঁকে জ্ঞানী একটি সন্তানের সুসংবাদ দিল’’[17]
এখানে জ্ঞানী সন্তান বলতে ইসহাক আলাইহিস সালামকে বুঝানো হয়েছে। অন্য আরেক বান্দাকে তিনি নাম দিয়েছেন ‘হালীম’। যেমন তিনি বলেছেন, ﴿ فَبَشَّرۡنَٰهُ بِغُلَٰمٍ حَلِيمٖ ١٠١  ‘‘আর আমরা তাঁকে সুসংবাদ দিলাম একজন সহনশীল সন্তানের।’’[18] এখানে সহনশীল সন্তান বলতে ঈসমাইল আলাইহিস সালামকে বুঝানো হয়েছে। এখানে ‘আল-‘আলীম’ ও আলীম এক নয় যেমনিভাবে ‘আল-হালীম’ ও হালীম এক নয়।
আল্লাহ নিজেকে নাম দিয়েছেন ‘আস-সামি‘ই’ এবং ‘আল-বাছীর’ বলে। যেমন তিনি বলেছেন,
﴿إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ سَمِيعَۢا بَصِيرٗا ٥٨ ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা।’’[19]
তিনি তাঁর কিছু কিছু বান্দাকে সামি‘ই এবং বাছীর নামে অভিহিত করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন,
﴿ إِنَّا خَلَقۡنَا ٱلۡإِنسَٰنَ مِن نُّطۡفَةٍ أَمۡشَاجٖ نَّبۡتَلِيهِ فَجَعَلۡنَٰهُ سَمِيعَۢا بَصِيرًا ٢ ﴾ [الانسان: ٢] 
‘‘অমি তো মানুষকে সৃষ্টি করেছি মিলিত শুক্রবিন্দু হতে, তাকে পরীক্ষা করার জন্য। এজন্য আমি তাকে করেছি শ্রবণশক্তি সম্পন্ন ও দৃষ্টিবান।’’[20] এখানে উল্লিখিত সামীয়‘ বা ‘শ্রবণশক্তি সম্পন্ন’ আর ‘আস-সামিয়’ একরকম নয়। আবার ‘বাছীর’ বা দৃষ্টিবান ও ‘আল-বাছীর’ অনুরূপ নয়, উভয়ের মধ্যে পার্থক্য আছে।
আল্লাহ তা‘আলা নিজেকে নাম দিয়েছেন ‘আর-রাউফ’ এবং ‘আর-রাহীম’ বলে। তিনি বলেছেন,
﴿ إِنَّ ٱللَّهَ بِٱلنَّاسِ لَرَءُوفٞ رَّحِيمٞ ٦٥  ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি দয়ালু ও করুণাময়।’’[21] অপরদিকে তিনি তাঁর কোনো কোনো বান্দাকে ‘রাউফ’ এবং ‘রাহীম’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন,
﴿ لَقَدۡ جَآءَكُمۡ رَسُولٞ مِّنۡ أَنفُسِكُمۡ عَزِيزٌ عَلَيۡهِ مَا عَنِتُّمۡ حَرِيصٌ عَلَيۡكُم بِٱلۡمُؤۡمِنِينَ رَءُوفٞ رَّحِيمٞ ١٢٨ ﴾ [التوبة: ١٢٨] 
‘‘নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল। তোমাদেরকে যা বিপন্ন করে তা তাঁর কাছে কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি দয়ার্দ্র ও পরম দয়ালু।’’[22]
এখানেও এ ‘রাউফ’ সে আর-রাউফের মত নয় যা আল্লাহর নাম এবং এ ‘রাহীম’ সে আর-রাহীমের মতও নয় যা আল্লাহর নাম।
অনুরূপভাবে আল্লাহ নিজের অনেক গুণ বর্ণনা করেছেন এবং একইরূপ গুণের বর্ণনা তিনি তাঁর কোন কোন বান্দার ক্ষেত্রেও করেছেন। যেমন তিনি বলেছেন,  ﴿ وَلَا يُحِيطُونَ بِشَيۡءٖ مِّنۡ عِلۡمِهِۦٓ ‘‘তারা তাঁর জ্ঞানের কোন কিছুই পরিবেষ্টন করতে পারে না।’’[23]
তিনি তাঁর নিজেকে জ্ঞানের গুণে গুণান্বিত করেছেন। আবার তিনি তাঁর বান্দাদেরও জ্ঞান আছে বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ﴿ وَمَآ أُوتِيتُم مِّنَ ٱلۡعِلۡمِ إِلَّا قَلِيلٗا ٨٥  ‘‘তোমাদেরকে খুব কম জ্ঞানই প্রদান করা হয়েছে।’’[24] তিনি আরো বলেন, ﴿ وَفَوۡقَ كُلِّ ذِي عِلۡمٍ عَلِيمٞ ٧٦  ‘‘প্রত্যেক জ্ঞানীর উপর রয়েছে এক মহা জ্ঞানী।’’[25] তিনি আরো বলেন, ﴿ وَقَالَ ٱلَّذِينَ أُوتُواْ ٱلۡعِلۡمَ ‘‘যাদেরকে জ্ঞান দেয়া হয়েছিল তারা বলল।’’[26] তিনি নিজের শক্তির গুণের কথা উল্লে­খ করে বলেছেন, ﴿ إِنَّ ٱللَّهَ لَقَوِيٌّ عَزِيزٌ ٤٠  ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিশালী ও পরাক্রমশালী।’’[27] তিনি আরো বলেন, ﴿ إِنَّ ٱللَّهَ هُوَ ٱلرَّزَّاقُ ذُو ٱلۡقُوَّةِ ٱلۡمَتِينُ ٥٨  ‘‘নিশ্চয়ই আল্লাহ রিজিকদাতা, শক্তিমান পরাক্রমশালী।’’[28] আবার তিনি তাঁর বান্দাদের ক্ষেত্রেও শক্তির কথা উল্লে­খ করেন। তিনি বলেন,
﴿ ۞ٱللَّهُ ٱلَّذِي خَلَقَكُم مِّن ضَعۡفٖ ثُمَّ جَعَلَ مِنۢ بَعۡدِ ضَعۡفٖ قُوَّةٗ ثُمَّ جَعَلَ مِنۢ بَعۡدِ قُوَّةٖ ضَعۡفٗا وَشَيۡبَةٗۚ ﴾ [الروم: ٥٤]   
‘‘আল্লাহই তোমাদেরকে দূর্বল থেকে সৃষ্টি করেছেন তারপর দূর্বলতার পরেই শক্তি দিয়েছেন। তারপর শক্তি দেয়ার পর আবারও দূর্বলতা ও বার্ধক্য দিয়েছেন।’’[29] এরকম আরো অনেকগুলো আয়াত রয়েছে।

এ কথা সবার জানা যে, আল্লাহর নামসমূহ ও তাঁর গুণাবলী তাঁর সাথে নির্দিষ্ট এবং তাঁরই উপযোগী। আর সৃষ্টিজগতের নাম ও গুণাবলী তাদের সাথেই নির্দিষ্ট ও তাদের উপযোগী। অতএব নাম এবং অর্থের মধ্যে একরকম হওয়ার দ্বারা তার হাক্বীকত ও মূলের মধ্যে একরকম হওয়া অপরিহার্য হয় না; কেননা দু’টো একই নাম বিশিষ্ট দুই ব্যক্তি এবং একই গুণ বিশিষ্ট দুই ব্যক্তি একরকম হওয়াটা অপরিহার্য নয় এটা স্পষ্ট।

তৃতীয় জবাব: যার কোন পরিপূর্ণ গুণাবলী নেই সে ইলাহ হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। এজন্যই ইবরাহীম আলাইহিস সালাম তাঁর বাবাকে বলেছিলেন, ﴿ لِمَ تَعۡبُدُ مَا لَا يَسۡمَعُ وَلَا يُبۡصِرُ  ‘‘আপনি কেন এমন বস্তুর ইবাদাত করছেন যা শুনেও না দেখেও না?’’[30] যারা গো-বাছুরের ইবাদাত করেছিল তাদের জবাব দিতে গিয়ে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ﴿أَلَمۡ يَرَوۡاْ أَنَّهُۥ لَا يُكَلِّمُهُمۡ وَلَا يَهۡدِيهِمۡ سَبِيلًاۘ  ‘‘তারা কি দেখেনি যে, এ গো-বাছুরটি তাদের সাথে কথা বলতে পারে না এবং তাদেরকে কোন পথও দেখাতে পারে না?’’[31]

চতুর্থ জবাব: আল্লাহর জন্য গুণাবলী সাব্যস্ত করা তাঁর পরিপূর্ণতার পরিচায়ক। আর এ গুণাবলী তাঁর থেকে অস্বীকার করা তাঁর ক্ষেত্রে ত্রুটি সৃষ্টিকারী; কেননা যার কোন গুণ নেই সে হয়ত অস্তিত্বহীন অথবা ত্রুটিপূর্ণ। আল্লাহ এসব কিছু থেকেই পবিত্র।

পঞ্চম জবাব: আল্লাহর গুণাবলীসমূহকে তার প্রকাশ্য ও স্পষ্ট অর্থ থেকে তা’বিল করার কোন দলীল নেই। তাই তা’বিল করাটা বাতিল বলে গণ্য। আর বোধগম্য নয় এ যুক্তিতে এ গুণাবলীগুলোর অর্থ আল্লাহর কাছে সমর্পণ করা অর্থাৎ ‘আল্লাহই ভাল জানেন’ এ কথা বলার দ্বারা এটা অপরিহার্য হয় যে, আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে আমাদেরকে এমন বক্তব্য দ্বারা সম্বোধন করেছেন যার অর্থ আমরা বুঝি না। অথচ তিনি আমাদেরকে তাঁর নাম ধরে ডাকার জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। সুতরাং আমরা কিভাবে তাঁকে এমন কিছু দ্বারা ডাকবো যার অর্থ আমরা জানি না? আমাদেরকে পুরো কুরআন নিয়ে চিন্তা গবেষণা করার নির্দেশ দান করা হয়েছে। তিনি কিভাবে আমাদেরকে এমন কিছু নিয়ে চিন্তা-ভাবনার নির্দেশ প্রদান করেন যার অর্থ আমরা বুঝি না?

এসব কিছু থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আল্লাহর নামসমূহ এবং তাঁর গুণাবলী অবশ্যই যেভাবে তাঁর জন্য উপযোগী হয় সেভাবে তাঁর জন্য সাব্যস্ত করাটা অত্যন্ত জরুরী। তবে পাশাপাশি মাখলুকের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়াকে অস্বীকার করতে হবে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ لَيۡسَ كَمِثۡلِهِۦ شَيۡءٞۖ وَهُوَ ٱلسَّمِيعُ ٱلۡبَصِيرُ ١١ ﴾ [الشورى: ١١]    
‘‘কোন কিছুই তাঁর মত নেই, তিনি সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’’[32]
অতএব তিনি কোন কিছু তাঁর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়াকে অস্বীকার করেছেন এবং তাঁর নিজের জন্য শ্রুতিশক্তি ও দৃষ্টিশক্তিকে সাব্যস্ত করেছেন। এ দ্বারা বুঝা গেল যে, সিফাত সাব্যস্ত করার দ্বারা সাদৃশ্যপূর্ণ হওয়া অপরিহার্য হয় না এবং এটাও বুঝা গেল যে, সাদৃশ্য অস্বীকার করেই সিফাতকে সাব্যস্ত করতে হবে। এটাই হচ্ছে আল্লাহর নামসমূহ ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে অস্বীকার ও সাব্যস্ত করার ব্যাপারে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের নীতিকথার অর্থ অর্থাৎ কোন সাদৃশ্য স্থাপন ছাড়াই তাঁর গুণাবলী সাব্যস্ত করতে হবে এবং বাতিল করা ছাড়াই তাঁর গুণাবলীকে পবিত্র রাখতে হবে।


[1] সূরা আল-আ‘রাফ: ১৮০
[2] সূরা ত্ব-হা: ৮
[3] সূরা আল-হাশর: ২২-২৪
[4] হাদিসটি মুত্তাফাকুন আলাইহি। সহীহ বুখারী ২৭৩৬ নং ও সহীহ মুসলিম ৬৯৮৬ নং।
[5] হাদিসটি মুসনাদ গ্রন্থে (৪৩১৮ নং) ইমাম আহমদ বর্ণনা করেছেন। ইবনে হিববান (৯৭২ নং) একে সহীহ হাদীস বলেছেন। এ হাদিসটি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহর নাম নিরানব্বই থেকেও অনেক বেশী। অতএব পূর্ববর্তী নিরানব্বই নামের হাদিসটি দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে, যে ব্যক্তি এ নিরানব্বইটি নাম শিখবে, সেগুলো দ্বারা আল্লাহকে আহবান করবে, আল্লাহর কাছে দো‘আ করবে এবং সেগুলোর উসিলায় আল্লাহর ইবাদাত করবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর এটি এ নিরানব্বইটি নামের ফযিলত ও বৈশিষ্ট্য।
[6] সূরা আল-ইখলাস: ১-৪
[7] হাদিসটি ইমাম বুখারী তার গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন, হাদীস নং ৭৪১।
[8] সহীহ বুখারী ,হাদীস নং ৬৯৪০।
[9] সূরা আর-রাহমান:২৭
[10] সূরা সোয়াদ: ৭৫
[11] সূরা আল-মায়েদা: ৬৪
[12] সূরা আশ-শুরা: ১১
[13] পূর্বেই বলা হয়েছে যে, এটি সঠিক পদ্ধতি নয়, এটি ভুল বিশ্বাস। কারণ, আল্লাহ তা‘আলার কুরআন ও রাসূলের সুন্নাত কোনো ধাঁধাঁ গ্রন্থ নয় যে, এখানে এমন কিছু থাকবে যে, তার প্রকাশ্য অর্থ করা যাবে না, আর তার অর্থ বুঝা যাবে না। [সম্পাদক]
[14] সূরা আর-রা‘দ : ৩০
[15] সূরা আল-ইসরা: ১১০
[16] সূরা আল-ফুরকান: ৬০
[17] সূরা আয-যারিয়াত: ২৮
[18] সূরা আস-সাফফাত: ১০১
[19] সূরা আন-নিসা: ৫৮
[20] সূা আল-ইনসান : ২
[21] সূরা আল-হজ: ৬৫
[22] সূরা আত-তাওবাহ : ১২৮
[23] সূরা আল-বাকারাহ : ২৫৫
[24] সূরা আল-ইসরা: ৮৫
[25] সূরা ইউসুফ: ৭৬
[26] সূরা আল-কাসাস: ৮০
[27] সূরা আল-হাজ্জ্ব: ৪০
[28] সূরা আয-যারিয়াত: ৫৮
[29] সূরা আর-রূম: ৫৪
[30] সূরা মারিয়াম: ৪২
[31] সূরা আল-আ’রাফ: ১৪৮
[32] সূরা আশ-শুরা: ১১

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন