তাওহীদ পরিচিতি-9
অনুবাদ: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
শাহাদাত
বাণীদ্বয়ের অর্থ এবং এতে যে সকল ভুল ও ত্রুটি হয়ে থাকে, শাহাদাত বাণীর রুকন, শর্ত,
দাবী ও তা ভঙ্গের কারণসমূহ
প্রথমতঃ
শাহাদাত বাণীদ্বয়ের অর্থ
১. ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বা ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোন প্রকৃত
ইলাহ নেই’ এ সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ হচ্ছে এ বিশ্বাস পোষণ করা ও এ স্বীকৃতি প্রদান করা
যে, আল্লাহ ছাড়া আর কেউই ইবাদাতের উপযুক্ত নয় আর এ বিষয়টি দৃঢ়ভাবে মেনে নেয়া এবং
তদনুযায়ী আমল করা। সুতরাং ‘লা-ইলাহা’ এ কথাটি মূলত: আল্লাহ ছাড়া আর যা কিছু রয়েছে সবকিছু থেকে ইবাদাতের
অধিকারকে অস্বীকার করার দিকে ইঙ্গিত প্রদান করে। আর ইবাদাত যে শুধুমাত্র আল্লাহরই
অধিকার, ‘ইল্লাল্লাহ’ কথাটি সেটি সাব্যস্ত করছে। সংক্ষেপে এ
কালেমার অর্থ হচ্ছে : ‘আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত
আর কোন মা‘বুদ নেই’।
এখানে ‘লা’ শব্দটির বিধেয় হিসেবে ‘বিহাক্কীন’ (প্রকৃত)
কথাটি উহ্য রয়েছে এবং ‘বেমাওজুদিন’ (অস্তিত্বশীল) শব্দটিকে বিধেয় হিসেবে (উহ্য
রয়েছে) উল্লেখ করা জায়েয নয়, কেননা
এটা হচ্ছে বাস্তবতার বিপরীত। কারণ আল্লাহ ছাড়া অনেক উপাস্য বাস্তবে অস্তিত্বশীল
রয়েছে। তাহলে অর্থ দাঁড়ায় এসব কিছুর ইবাদাত আল্লাহ তা‘আলারই ইবাদাতের শামিল। অথচ এটি হচ্ছে সবচেয়ে বড় বাতিল ও
অসত্য বচন। আর এটি হচ্ছে সর্বেশ্বরবাদীদের অভিমত ও নীতি, যারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সত্যবিরোধী
বলে বিবেচিত। এ কালেমাটির বিভিন্ন বাতিল ও বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তার
মধ্যে রয়েছে যেমন,
ক. এর অর্থ হল ‘আল্লাহ
ছাড়া আর কোন মা‘বুদ বা উপাস্য নেই’। এটা বাতিল; কেননা এ কথাটির অর্থ এই দাঁড়ায় যে,
হক্ব ও বাতিল সকল উপাস্যই হচ্ছেন আল্লাহ, যেভাবে ইতোপূর্বে বলা হয়েছে।
খ. এর অর্থ হচ্ছে ‘আল্লাহ
ছাড়া কোন স্রষ্টা নেই’। মূলত: এ অর্থটি এ কালেমার মূল অর্থের অংশবিশেষ, যা কালেমার
মূল উদ্দেশ্য নয়। কেননা এর দ্বারা শুধুমাত্র তাওহীদুর রুবুবিয়্যাই সাব্যস্ত হয়ে
থাকে। অথচ তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য এ অংশটুকুই যথেষ্ট নয়। আর মুশরিকগণও এ ধরনের
তাওহীদকে স্বীকৃতি দিয়েছিল।
গ. এর অর্থ হল ‘আল্লাহ
ছাড়া আর কোন আইনদাতা হুকুমদাতা নেই’। এটিও এ কালেমার মূল অর্থের অংশ মাত্র যা
কালেমার মূল উদ্দেশ্য নয়। কেননা শুধু এতটুকুই যথেষ্ট নয়। কারণ যদি কেউ আল্লাহকে
একমাত্র হুকুমদাতা হিসেবে মেনে নেয় এবং পাশাপাশি সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো কাছে
দো‘আ করে অথবা অন্য কারো জন্য কোন ইবাদাত
পালন করে থাকে তাহলে সে তাওহীদবাদী বলে বিবেচিত হবে না।
অতএব
কালেমার এ তিন প্রকারের ব্যাখ্যাই বাতিল অথবা ত্রুটিপূর্ণ। সালাফ ও মুহাক্কিক
আলেমদের কাছে এ কালেমার সঠিক ব্যাখ্যা হল এ কথা বলা যে, ‘‘আল্লাহ ছাড়া প্রকৃত সত্যিকার কোন মা‘বুদ বা উপাস্য নেই’’।
২. ‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল’ - এ সাক্ষ্য দেয়ার অর্থ
হচ্ছে প্রকাশ্যে ও গোপনে এ স্বীকৃতি প্রদান যে, তিনি আল্লাহর বান্দা ও সকল
মানুষের কাছে তাঁর প্রেরিত রাসূল। আর এ স্বীকৃতির দাবী অনুযায়ী তিনি যে নির্দেশ
দিয়েছেন সে ব্যাপারে তাঁর আনুগত্য করা, তিনি যে সংবাদ দিয়েছেন তাতে তাকে সত্য
প্রতিপন্ন করা, তিনি যা থেকে নিষেধ করেছেন এবং সতর্ক করেছেন তা পরিহার করা এবং
তিনি যা প্রচলন করেছেন কেবল সে পন্থায়ই আল্লাহর ইবাদাত করা।
দ্বিতীয়তঃ
শাহাদাত বাণীদ্বয়ের রুকনসমূহ
ক. ‘লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ’
এর দু’টো রুকন রয়েছে। একটি হচ্ছে না বাচক, আরেকটি হচ্ছে হ্যাঁ বাচক। প্রথম রুকনটি
হচ্ছে না বাচক-‘লা ইলাহা’। এ না বাচক কথাটি সকল শির্ককে বাতিল বলে ঘোষণা করেছে এবং
আল্লাহ ছাড়া আর যত কিছুর ইবাদাত, আরাধনা ও উপাসনা করা হয় সে সকল কিছুর প্রতি
অস্বীকৃতিকে অপরিহার্য করেছে। দ্বিতীয় রুকনটি হচ্ছে হ্যাঁ বাচক-‘ইল্লাল্লাহ’। এ রুকনটি দ্বারা সাব্যস্ত হয় যে, আল্লাহ
ছাড়া আর কোন কিছুই ইবাদাতের হক্বদার ও অধিকারী নয় এবং সে অনুযায়ী আমল করাকে এ রুকন
অপরিহার্য করে। এ দুটো অর্থে অনেকগুলো আয়াত আল-কুরআনে এসেছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿فَمَن يَكۡفُرۡ بِٱلطَّٰغُوتِ وَيُؤۡمِنۢ بِٱللَّهِ فَقَدِ ٱسۡتَمۡسَكَ
بِٱلۡعُرۡوَةِ ٱلۡوُثۡقَىٰ﴾ [البقرة: ٢٥٦]
‘‘যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করে এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন
করে সে সুদৃঢ় রজ্জুকে আঁকড়ে ধরল।’’[1] এখানে ‘যে ব্যক্তি তাগুতকে অস্বীকার করে’ এটি প্রথম
রুকন ‘লা-ইলাহা’ এর অর্থ। আর পরের ‘আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করে’ কথাটি দ্বিতীয়
রুকন ‘ইল্লাল্লাহ’ এর অর্থ। অনুরূপভাবে ইবরাহীম আলাইহিস সাল্লাম সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলার বাণী:
﴿إِنَّنِي بَرَآءٞ مِّمَّا تَعۡبُدُونَ ٢٦ إِلَّا ٱلَّذِي فَطَرَنِي﴾ [الزخرف: ٢٦، ٢٧]
‘‘নিশ্চয়ই আমি মুক্ত তোমরা যার ইবাদাত করছো তার থেকে,
অবশ্য সেই সত্ত্বা ছাড়া যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন।’’[2] ‘‘নিশ্চয়ই আমি মুক্ত’’ এ কথাটি প্রথম রুকনের না বোধক
বক্তব্যের অর্থ এবং ‘‘অবশ্য সেই সত্ত্বা ছাড়া যিনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন’’ কথাটি
দ্বিতীয় রুকনের হাঁ বোধক বক্তব্যের অর্থ।
‘মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল - এ ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়ার
রুকন রয়েছে দু’টো। সেগুলো হল- তিনি আল্লাহর বান্দা এবং তিনি আল্লাহর রাসূল। এ
দু’টো রুকন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়া সাল্লামের ব্যাপারে যে কোন ধরনের বাড়াবাড়ি অথবা ত্রুটি করার ব্যাপারে
নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। কেননা তিনি হচ্ছেন আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। এ দু’টো
মর্যাদাপূর্ণ গুণের মধ্য দিয়েই তিনি হচ্ছেন সৃষ্টিজগতের সবচেয়ে উত্তম ও পরিপূর্ণ
ব্যক্তিত্ব। এখানে ‘আল্লাহর বান্দা’ কথাটির অর্থ হচেছ তিনি আল্লাহর অধিনস্থ ও
আল্লাহর ইবাদাতকারী অর্থাৎ তিনি আল্লাহরই সৃষ্ট মানুষ এবং মানুষকে যা থেকে তিনি
সৃষ্টি করেছেন তাঁকেও তা থেকেই সৃষ্টি করেছেন। মানুষের ক্ষেত্রে যা যা হয়ে থাকে
তার ক্ষেত্রে সে একই বিষয়গুলো হয়ে থাকে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ قُلۡ إِنَّمَآ أَنَا۠ بَشَرٞ مِّثۡلُكُمۡ ﴾ [الكهف: ١١٠، فصلت: ٦]
‘‘বল, নিশ্চয়ই আমি তো তোমাদের মতই একজন।’’[3]
রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ হক্ব ও দায়িত্ব পুরোপুরি পালন
করেছিলেন। আল্লাহ সে ব্যাপারে তাঁর প্রশংসাও করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ أَلَيۡسَ ٱللَّهُ بِكَافٍ عَبۡدَهُۥۖ ﴾
‘‘আল্লাহ কি তাঁর বান্দা (মুহাম্মাদ)এর জন্য যথেষ্ট
নন?’’[4]
﴿ ٱلۡحَمۡدُ لِلَّهِ ٱلَّذِيٓ أَنزَلَ عَلَىٰ عَبۡدِهِ ٱلۡكِتَٰبَ
﴾ [الكهف: ١]
‘‘সকল প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য যিনি তাঁর
বান্দার উপর নাযিল করেছেন গ্রন্থ।’’[5]
﴿ سُبۡحَٰنَ ٱلَّذِيٓ أَسۡرَىٰ بِعَبۡدِهِۦ لَيۡلٗا مِّنَ ٱلۡمَسۡجِدِ
ٱلۡحَرَامِ ﴾ [الاسراء: ١]
‘‘সেই সত্ত্বার প্রশংসা ও
পবিত্রতা যিনি তাঁর বান্দা মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাত্রিকালে
মাসজিদুল হারাম থেকে ভ্রমণ করিয়েছেন।’’[6]
আর ‘‘রাসূল’’ অর্থ হচ্ছে সে ব্যক্তি যাকে সকল মানুষের কাছে সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে আল্লাহর
প্রতি দাওয়াত দেয়ার জন্য প্রেরণ করা হয়েছে। ‘আল্লাহর বান্দা ও রাসূল’ এ দু’টো গুণে
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বিশেষিত করে শাহাদাহ বা সাক্ষ্য দেয়ার
উদ্দেশ্য হল তাঁর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করাকে নিষেধ করা এবং তাঁর বিষয়ে ত্রুটিপূর্ণ
আচরণ করাকেও অগ্রাহ্য করা। কেননা তাঁর উম্মতের দাবীদার এমন বহু লোকই তাঁর ব্যাপারে
বাড়াবাড়ি করেছে, এমনকি তাঁকে উবুদিয়াত বা বান্দার স্তর থেকে আল্লাহর পরিবর্তে উপাস্যের
স্তরে উপনীত করেছে। আল্লাহকে বাদ দিয়ে তাঁর কাছেই তারা সাহায্য প্রার্থনা করেছে।
নিজেদের প্রয়োজন পূরণের ব্যাপারে অথবা বিপদ থেকে উদ্ধারের ব্যাপারে তাঁর কাছেই
তারা প্রার্থনা করেছে, অথচ আল্লাহ ছাড়া তা আর কেউ দিতে পারে না। আবার কেউ কেউ তাঁর
রিসালাতকে অস্বীকার করেছে অথবা তাঁকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনুসরণ করার ব্যাপারে
যথেষ্ট ত্রুটি দেখিয়েছে এবং তিনি যে আদর্শ নিয়ে এসেছেন তাঁর বিপরীত কথা ও মতামতের
উপর নির্ভর করেছে। তাঁর বিধান ও তাঁর দেয়া সংবাদকে ভিন্নার্থে প্রয়োগের অপচেষ্টা
তারা করেছে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন