তাওহীদ পরিচিতি-3
অনুবাদ: ড. মোহাম্মদ মানজুরে ইলাহী
সম্পাদনা: ড. আবু বকর মুহাম্মাদ যাকারিয়া
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
আল-কুরআন,
আস-সুন্নাহ্ ও ভ্রষ্ট জাতিসমূহের ধারণায় ‘আর-রব’ শব্দটির অর্থ
১. আল-কুরআন ও আস-সুন্নায় ‘আর-রব’ শব্দটির অর্থ:
‘আর-রাব’ মূলে ‘রাববা’,
‘ইয়ারুববু’ এর ক্রিয়ামূল। এর অর্থ হচ্ছে কোন বস্তুকে প্রতিপালন করে এক
অবস্থা থেকে অন্য অবস্থায় তথা পূর্ণ অবস্থায় নিয়ে যাওয়া। আরবীতে বলা হয়, ‘রববাহু,
ওয়া-রাববা-হু, ওয়া-রাববাবাহু’। সুতরাং ‘রব’ শব্দটি কর্তৃকারকের জন্য ব্যবহৃত একটি
ক্রিয়ামূল। ‘আর-রাববু’ শব্দটি শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই প্রযোজ্য, যিনি
জগতের সকল কিছুর জন্য যা মঙ্গলজনক তার জিম্মাদার। তিনি ছাড়া আর কারোর জন্যই এটা বলা
যাবে না, যেমন আল্লাহর বাণী,
আল্লাহ আরো বলেন,
﴿ٱللَّهَ
رَبَّكُمۡ وَرَبَّ ءَابَآئِكُمُ ٱلۡأَوَّلِينَ ١٢٦ ﴾ ‘‘আল্লাহ তোমাদের রব এবং তোমাদের বাপ-দাদাদের
রব।’’[2]
আল্লাহ ছাড়া অন্যদের জন্য এ শব্দটি সুনির্দিষ্ট সম্বন্ধবাচক
শব্দ হিসেবে হলেই শুধু বলা যাবে। যেমন বলা হয়, ‘রাববুদ্দার’ অর্থাৎ ঘরের
মালিক ও ‘রাববুল ফারাস’ অর্থাৎ ঘোড়ার মালিক। এ অর্থেই আল্লাহ তা‘আলার নিম্নোক্ত বাণীতে ইউসুফ আলাইহিস সাল্লামের বক্তব্য
পেশ হয়েছে বলে আয়াতের তাফসীরের মধ্যে একটি মত রয়েছে।
﴿ ٱذۡكُرۡنِي عِندَ رَبِّكَ فَأَنسَىٰهُ ٱلشَّيۡطَٰنُ ذِكۡرَ رَبِّهِۦ
﴾ [يوسف: ٤٢]
‘‘তুমি তোমার
পালনকারীর কাছে আমাকে স্মরণ করো কিন্তু শয়তান তার মালিকের কাছে তার কথা স্মরণ করতে
তাকে ভুলিয়ে দিয়েছে।’’[3]
আর আল্লাহ তা‘আলার
বাণী, ﴿ قَالَ ٱرۡجِعۡ إِلَىٰ رَبِّكَ ٥٠ ﴾ [يوسف] ‘‘তিনি বললেন তুমি তোমার পালনকারীর কাছে ফিরে যাও।’’[4] আল্লাহ তা‘আলার আরেক বাণী হচ্ছে,
﴿ أَمَّآ
أَحَدُكُمَا فَيَسۡقِي رَبَّهُۥ خَمۡرٗاۖ ﴾ [يوسف:
٤١] ‘‘তোমাদের
একজন তার পালনকারীকেকে শরাব পান করাবে।’’[5]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হারিয়ে
যাওয়া উষ্ট্রী সম্পর্কে বলেছিলেন, حَتَّى يَجِدَهَا رَبُّهَا অর্থাৎ যতক্ষণ না উষ্ট্রীর রব তাকে ফিরে পায়।[6]
এর দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল যে আল্লাহর ক্ষেত্রে ‘আর-রব’
সুনির্দিষ্ট বিশেষ্যপদ ও সম্বন্ধবাচক পদ হিসেবে উভয় ভাবেই ব্যবহৃত হতে পারে।
সুতরাং এভাবে বলা যেতে পারে : ‘আর-রব’ অথবা ‘রাববুল ‘আলামীন’ অথবা ‘রাববুন্নাস’। তবে আল্লাহ ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে ‘আর-রব’ বলা যাবে
না। অবশ্য শব্দটিকে অন্যদের ক্ষেত্রে সম্বন্ধবাচক শব্দ হিসেবে ব্যবহার করা যেতে
পারে যেমন, ‘রাববুল মানযিল’ অর্থাৎ বাড়ির মালিক, ‘রাববুদ্দার’
অর্থাৎ ঘরের মালিক, ‘রাববুল ইবিল’ অর্থাৎ উটের মালিক।
আর রাববুল আলামীন কথাটির অর্থ হচ্ছে, তাদের
স্রষ্টা ও মালিক, তাদের সংশোধনকারী এবং বহু নিয়ামত দিয়ে, রাসূলদেরকে পাঠিয়ে ও
গ্রন্থসমূহ নাযিল করে তাদের প্রতিপালনকারী এবং তাদের আমলের পুরস্কার দানকারী। আল্লামা
ইবনুল কাইয়্যেম রাহেমাহুল্লাহ বলেন, ‘‘রুবুবিয়্যাহ কথাটির দাবী হল বান্দাদেরকে
নির্দেশ প্রদান করা, তাদেরকে নিষেধ করা এবং বান্দাদের যারা সৎ তাদেরকে এহসান দিয়ে
পুরস্কৃত করা ও যারা পাপী তাদেরকে পাপের সাজা দেয়ার ক্ষমতা প্রয়োগ।’’[7]
২. ভ্রষ্টজাতিসমূহের ধারণায় ‘আর-রব ’ শব্দটির
অর্থ:
আল্লাহ সৃষ্টিকূলকে তাওহীদের প্রতি স্বভাবসুলভ আকর্ষণ ও
মহান রব তথা স্রষ্টার পরিচিতি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন,
﴿ فَأَقِمۡ وَجۡهَكَ لِلدِّينِ حَنِيفٗاۚ فِطۡرَتَ ٱللَّهِ ٱلَّتِي
فَطَرَ ٱلنَّاسَ عَلَيۡهَاۚ لَا تَبۡدِيلَ لِخَلۡقِ ٱللَّهِۚ ﴾ [الروم: ٣٠]
‘‘অতএব তুমি একনিষ্ঠ হয়ে নিজেকে দ্বীনের জন্য প্রতিষ্ঠিত
করো। (এ-দ্বীন-টি) আল্লাহর ফিতরাত, যা অনুযায়ী তিনি মানবকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর
সৃষ্টির কোন পরিবর্তন নেই।’’[8]
আল্লাহ তা‘আলা
আরো বলেন:
﴿ وَإِذۡ أَخَذَ رَبُّكَ مِنۢ بَنِيٓ ءَادَمَ مِن ظُهُورِهِمۡ
ذُرِّيَّتَهُمۡ وَأَشۡهَدَهُمۡ عَلَىٰٓ أَنفُسِهِمۡ أَلَسۡتُ بِرَبِّكُمۡۖ قَالُواْ
بَلَىٰ شَهِدۡنَآۚ ﴾ [الاعراف: ١٧١]
‘‘আর স্মরণ
কর তোমার রব আদম সন্তানের পৃষ্ঠদেশ হতে তার বংশধরদেরকে বের করেন এবং তাদের নিজেদের
সম্বন্ধে স্বীকারোক্তি গ্রহণ করেন এবং বলেন, আমি কি তোমাদের রব নই? তারা বলল,
হ্যাঁ অবশ্যই, আমরা সাক্ষী রইলাম।’’[9]
সুতরাং আল্লাহর
রুবুবিয়্যাতের প্রতি স্বীকৃতি প্রদান এবং তার প্রতি মনোনিবেশ একটি স্বভাবজাত বিষয়।
আর শির্ক হচ্ছে একটি আরোপিত বা আপতিত ঘটনা। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
বলেছেন,
«كُلُّ مَوْلُودٍ يُولَدُ عَلَى الْفِطْرَةِ
فَأَبَوَاهُ يُهَوِّدَانِهِ أَوْ يُنَصِّرَانِهِ أَوْ يُمَجِّسَانِهِ»
‘‘প্রত্যেক নবজাতক ফিৎরাত তথা ইসলামের উপর জন্মগ্রহণ
করে। অত:পর তার বাবা-মা তাকে ইয়াহুদি অথবা নাসারা কিংবা মাজুসি তথা অগ্নিউপাসকে
পরিণত করে।’’[10]
অতএব বান্দাকে যদি তার স্বভাবজাত ফিতরাত সহ ছেড়ে দেওয়া
হয় তাহলে সে তাওহীদ অভিমূখী হবে এবং রাসূলগণের দাওয়াতকে গ্রহণ করবে। এ তাওহীদ
নিয়েই আগমন করেছেন রাসূলগণ, নাযিল হয়েছে সকল আসমানী গ্রন্থ আর এর উপর প্রমাণ বহন
করছে জাগতিক বহু নিদর্শন। কিন্তু বিচ্যুত তারবিয়াত ও শিক্ষা এবং নাস্তিকবাদী
পরিবেশ- এদু’টো নবজাতকের দৃষ্টিভঙ্গিকে পরিবর্তন করে দেয়। আর সেখান থেকেই সন্তানরা
ভ্রষ্টতা ও বক্রতায় তাদের বাবা-মায়ের অন্ধ অনুকরণ করে থাকে। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ
তা‘আলা বলেন,
«وَإِنِّى خَلَقْتُ عِبَادِى حُنَفَاءَ
كُلَّهُمْ وَإِنَّهُمْ أَتَتْهُمُ الشَّيَاطِينُ فَاجْتَالَتْهُمْ عَنْ دِينِهِمْ»
‘‘আমি আমার
বান্দাদের সকলকে একনিষ্ঠ (মুসলিম) করে সৃষ্টি করেছি। অত:পর শয়তান তাদের কাছে এসে
তাদেরকে তাদের দ্বীন থেকে সরিয়ে দেয়’’[11]
অর্থাৎ শয়তান তাদেরকে
প্রতিমাসমূহের ইবাদাতের প্রতি ফিরিয়ে দেয় এবং আল্লাহ ছাড়া আরো অনেক রব গ্রহণ করার
প্রতি উদ্বুদ্ধ করে; যার ফলে তারা ভ্রষ্টতা, ধ্বংস, বিচ্ছিন্নতা ও মতানৈক্যে পতিত
হয়। তাদের প্রত্যেকেই, অন্যের গ্রহণ করা রব বাদ দিয়ে নিজের জন্য এমন এক রব গ্রহণ
করে যার সে ইবাদাত করে; কেননা তারা যখন সত্যিকার রবকে পরিত্যাগ করেছে তখন বাতিল
রবদেরকে গ্রহণ করার মুসিবতে তারা নিপতিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ فَذَٰلِكُمُ ٱللَّهُ رَبُّكُمُ ٱلۡحَقُّۖ فَمَاذَا بَعۡدَ ٱلۡحَقِّ
إِلَّا ٱلضَّلَٰلُۖ ﴾ [يونس : ٣٢]
‘‘তিনি আল্লাহ তোমাদের সত্য রব। সত্য ত্যাগ করার পর বিভ্রান্তি ব্যতীত আর কি থাকে?’’[12] আর বিভ্রান্তির কোন সীমানা বা শেষ নেই। যারাই তাদের
প্রকৃত রব থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই অপরিহার্যভাবে বিভ্রান্তি
বিরাজ করে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ءَأَرۡبَابٞ مُّتَفَرِّقُونَ خَيۡرٌ أَمِ ٱللَّهُ ٱلۡوَٰحِدُ
ٱلۡقَهَّارُ ٣٩ مَا تَعۡبُدُونَ مِن دُونِهِۦٓ إِلَّآ أَسۡمَآءٗ سَمَّيۡتُمُوهَآ
أَنتُمۡ وَءَابَآؤُكُم مَّآ أَنزَلَ ٱللَّهُ بِهَا مِن سُلۡطَٰنٍۚ ﴾ [يوسف: ٣٩، ٤٠]
‘‘ভিন্ন ভিন্ন বহু রব শ্রেয় নাকি পরাক্রমশালী এক আল্লাহ ? তাঁকে ছেড়ে
তোমরা কেবল কতগুলো নামের ইবাদাত করছ যে নামগুলো তোমরা ও তোমাদের পিতৃপুরুষরা
রেখেছো। এগুলোর কোন প্রমাণ আল্লাহ নাযিল করেন নি।’’[13]
গুণাবলী ও কর্মের ক্ষেত্রে দু’জন সমকক্ষ স্রষ্টা সাব্যস্ত
করার মাধ্যমে রুবুবিয়্যাতের ক্ষেত্রে শির্ক করা মূলত অসম্ভব। তবে কতিপয় মুশরিকের
মতামত হল, তাদের উপাস্যগণ জগতের কোন কোন ক্ষেত্রে তাসাররুফ তথা পরিবর্তন-পরিবর্ধনের
অধিকার রাখে। মূলত এ সকল উপাস্যের উপাসনার ব্যাপারে শয়তান তাদেরকে নিয়ে একটি খেলায়
মেতে উঠেছে এবং প্রত্যেক জাতির সাথে শয়তান তাদের বুদ্ধি বিবেকের কম-বেশ অনুসারে
খেল তামাশা করেছে। একদলকে শয়তান এসকল উপাস্যের ইবাদাতের দিকে আহ্বান করেছে
মৃতদেরকে সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে, যারা সেসকল প্রতিমাকে এ সব মৃত লোকের ছবি
অনুযায়ী সাজিয়েছে, যেমন নূহ এর জাতি। আরেকদল নক্ষত্র ও গ্রহের আকার দিয়ে প্রতিমাগুলোর
পুজো করছে। তাদের ধারণা এসব নক্ষত্র ও গ্রহ বিশ্বজগতের উপর ক্রিয়াশীল। তাই তারা
এসব প্রতিমার জন্য ঘর ও সেবক তৈরী করেছে।
এসকল গ্রহ-নক্ষত্রের ইবাদাত নিয়ে তারা নিজেরাও মতভেদে
লিপ্ত হয়েছে। তাদের কেউ সূর্যের ইবাদাত করে আর কেউ করে চন্দ্রের ইবাদাত। কেউ আবার
চন্দ্র-সূর্য বাদ দিয়ে অন্যান্য গ্রহ-নক্ষত্রের ইবাদাত করে থাকে। এমনকি তারা সেসব
গ্রহ-নক্ষত্রের প্রতিকৃতিও বানিয়ে নিয়েছে। প্রতিটি গ্রহের জন্য রয়েছে একটি বিশেষ
প্রতিকৃতি। এ সব পূজারীদের মধ্যে কেউ কেউ আবার অগ্নিপূজাও করে থাকে, তারা হচ্ছে
মাজূস। তাদের কেউ আবার গাভীর পূজা করে থাকে, যেমন ভারতে দেখা যায়। তাদের মধ্যে
অনেকে মালাঈকা তথা ফিরিশতাদের পূজা করে থাকে। অনেকে আবার বৃক্ষ ও পাথরের পূজা করে
থাকে। তাদের অনেকে কবর এবং কবরের উপর যে সৌধ স্থাপন করা হয় সেগুলোর ইবাদাত করে
থাকে। এর কারণ হল এসকল বস্তুর মধ্যে রুবুবিয়্যাতের বৈশিষ্ট্যের কিছু অংশ আছে বলে
তারা ধারণা করে।
এদের একদল এ ধারণা পোষণ করে যে, এ সকল প্রতিমা অদৃশ্য ও
গায়েবী কিছুর প্রতিনিধিত্ব করে। ইবনুল কাইয়্যেম বলেন, ‘‘প্রকৃতপক্ষে অদৃশ্য
উপাস্যের প্রতিকৃতিতেই প্রতিমা তৈরী করা হয়েছিল। তারা প্রতিমাকে অদৃশ্য উপাস্যের
প্রতিকৃতি, অবস্থা ও ছবি অনুযায়ী তৈরী করেছে যাতে এ প্রতিমা সে অদৃশ্য উপাস্যের
স্থলাভিষিক্ত হতে পারে। নতুবা এটাতো সকলেরই জানা যে, কোন বিবেকবান তার নিজের হাতে
একটি কাষ্ঠখন্ড অথবা পাথরকে খোদাই করে এ আকীদা পোষণ করতে পারে না যে, সে তার ইলাহ
বা উপাস্য... ... ... ।’’[14]
অনুরূপভাবে প্রাচীন ও আধুনিক যুগের কবরপূজারীগণ ধারণা
করে থাকে যে, এ সকল মৃত ব্যক্তিগণ তাদের জন্য শাফায়াত করবে এবং তাদের অভাব পূরণে ও
হাজত পূরণে আল্লাহর কাছে তাদের ব্যাপারে মধ্যস্থতা করবে। তাদের বক্তব্য আল্লাহ
কুরআনে উল্লেখ করেছেন এভাবে,
﴿ مَا نَعۡبُدُهُمۡ إِلَّا لِيُقَرِّبُونَآ إِلَى ٱللَّهِ زُلۡفَىٰٓ
﴾ [الزمر: ٣]
‘‘আমরা এদের ইবাদাত তো এজন্যই করি যে এরা আমাদেরকে আল্লাহর
নিকটবর্তী করে দেবে।’’[15]
﴿وَيَعۡبُدُونَ مِن دُونِ ٱللَّهِ مَا لَا يَضُرُّهُمۡ وَلَا يَنفَعُهُمۡ
وَيَقُولُونَ هَٰٓؤُلَآءِ شُفَعَٰٓؤُنَا عِندَ ٱللَّهِۚ ﴾ [يونس
: ١٨]
‘‘আর তারা আল্লাহ ব্যতীত এমন বস্তুর ইবাদাত করে থাকে, যা তাদের কোন
ক্ষতি করতে পারে না এবং তাদের কোন কল্যাণও সাধন করতে পারে না। আর তারা বলে, এরা আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য শাফায়াতকারী।’’[16]
অনুরূপভাবে আরবের কতিপয় মুশরিক এবং খৃষ্টানগণ তাদের মা‘বুদ
ও উপাস্যের ব্যাপারে ধারণা করত যে, এরা আল্লাহর সন্তান। আরবের মুশরিকরা ফিরিশতাদের
ইবাদাত করত এ বিশ্বাসে যে, এরা আল্লাহর কন্যা। আর খৃষ্টানগণ মাসীহ আলাইহিস
সাল্লামের ইবাদাত করত এ বিশ্বাসে যে, তিনি আল্লাহর পুত্র।
৩. এসব বাতিল ধারণার অপনোদন:
নিম্নবর্ণিত আয়াতসমূহ দ্বারা আল্লাহ তা‘আলা এসকল বাতিল
ধারণা অপনোদন করেছেন।
(ক). যারা প্রতিমাপূজারী তাদের অপনোদন করা হয়েছে আল্লাহর
এ বাণী দিয়ে:
﴿ أَفَرَءَيۡتُمُ ٱللَّٰتَ وَٱلۡعُزَّىٰ ١٩ وَمَنَوٰةَ ٱلثَّالِثَةَ
ٱلۡأُخۡرَىٰٓ ٢٠ ﴾ [النجم : ١٩، ٢٠]
আয়াতটির অর্থের ব্যাখ্যায় কুরতুবী বলেছেন, ‘‘তোমরা কি
এসকল উপাস্যদেরকে অবলোকন করেছ! এরা কি কোন কল্যাণ সাধন করেছে অথবা ক্ষতি করেছে,
যার ফলে এরা মহান আল্লাহর শরীক হতে পারে? অথবা তারা কি নিজেদেরকে রক্ষা করতে
পেরেছিল যখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবাগণ (রাদিয়াল্লাহু
আনহুম) এগুলো ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছিলেন ও ধ্বংস করেছিলেন?
আল্লাহ তা‘আলা
আরো বলেন,
﴿ وَٱتۡلُ عَلَيۡهِمۡ نَبَأَ إِبۡرَٰهِيمَ ٦٩ إِذۡ قَالَ لِأَبِيهِ
وَقَوۡمِهِۦ مَا تَعۡبُدُونَ ٧٠ قَالُواْ نَعۡبُدُ أَصۡنَامٗا فَنَظَلُّ لَهَا عَٰكِفِينَ
٧١ قَالَ هَلۡ يَسۡمَعُونَكُمۡ إِذۡ تَدۡعُونَ ٧٢ أَوۡ يَنفَعُونَكُمۡ أَوۡ يَضُرُّونَ
٧٣ قَالُواْ بَلۡ وَجَدۡنَآ ءَابَآءَنَا كَذَٰلِكَ يَفۡعَلُونَ ٧٤ ﴾ [الشعراء : ٦٩، ٧٤]
‘‘এদের কাছে ইবরাহীমের ঘটনা বর্ণনা কর। সে যখন তার পিতা ও
জাতিকে বলেছিল তোমরা কিসের ইবাদাত করো? তারা বলল,
আমরা মূর্তিপূজা করি এবং আমরা নিষ্ঠার সাথে এদের পূজায় নিরত থাকব। সে বলল, তোমরা
প্রার্থনা করলে ওরা কি শোনে? অথবা ওরা কি তোমাদের উপকার কিংবা অপকার করতে পারে?
তারা বলল, না, তবে আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে এরূপই করতে দেখেছিলাম।’’[18]
তারা এ ব্যাপারে একমত হয়েছে যে, এ সকল মূর্তি ও প্রতিমাসমূহ
কোন দো‘আ ও আহ্বান শুনতে পায় না। তারা কল্যাণ সাধন করতে পারে না, ক্ষতিও করতে পারে
না। তারা শুধু তাদের পিতৃপুরুষদের অন্ধ অনুকরণেই এগুলোর ইবাদাত করত বা পূজা করত।
আর অন্ধ অনুকরণ একটি বাতিল দলীল।
(খ). যারা গ্রহ-সূর্য ও চন্দ্রের পূজা করত আল্লাহ তাদের
জবাব দিয়েছেন নিম্নের বাণী দ্বারা,
﴿ وَٱلشَّمۡسَ وَٱلۡقَمَرَ وَٱلنُّجُومَ مُسَخَّرَٰتِۢ بِأَمۡرِهِۦٓۗ
﴾ [الاعراف: ٥٣]
তিনি আরো বলেন,
﴿ وَمِنۡ ءَايَٰتِهِ ٱلَّيۡلُ وَٱلنَّهَارُ وَٱلشَّمۡسُ وَٱلۡقَمَرُۚ
لَا تَسۡجُدُواْ لِلشَّمۡسِ وَلَا لِلۡقَمَرِ وَٱسۡجُدُواْۤ لِلَّهِۤ ٱلَّذِي خَلَقَهُنَّ
إِن كُنتُمۡ إِيَّاهُ تَعۡبُدُونَ ٣٧ ﴾ [فصلت:
٣٧]
‘‘তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে রাত-দিন, সূর্য ও চন্দ্র। তোমরা
সূর্য ও চন্দ্রের উদ্দেশ্যে সিজদাহ করো না বরং সিজদাহ করো সেই আল্লাহর উদ্দেশ্যে
যিনি এ সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন যদি তোমরা তাঁরই ইবাদাত করে থাক।’’[20]
(গ). যারা ফিরিশতা ও
মাসীহ আলাইহিস্ সাল্লামের পূজা করত তাদেরকে আল্লাহর সন্তান মনে করে, আল্লাহ তাদের
বক্তব্য অপনোদন করেছেন তাঁর এই বাণী দিয়ে:
তাঁর আরো বাণী: ﴿ أَنَّىٰ يَكُونُ لَهُۥ وَلَدٞ وَلَمۡ تَكُن لَّهُۥ صَٰحِبَةٞۖ
﴾ [الانعام: ١٠١] ‘‘তাঁর সন্তান
কিভাবে হতে পারে অথচ তাঁর কোন স্ত্রী ছিল না?’’[22] তিনি আরো বলেন:
﴿ لَمۡ يَلِدۡ وَلَمۡ يُولَدۡ ٣ وَلَمۡ يَكُن لَّهُۥ كُفُوًا أَحَدُۢ
٤ ﴾ [الاخلاص: ٣، ٤]
‘‘তাঁর কোন সন্তান নেই এবং তিনিও কারো সন্তান নন। কেউই তাঁর সমকক্ষ
নয়।’’[23]
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন