শনিবার, ১৬ মার্চ, ২০১৩

ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের প্রবর্তক শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদী (রাঃ)-এর সংগ্রামী জীবন-১


ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের প্রবর্তক শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদী (রাঃ)-এর সংগ্রামী জীবন-



শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদী (রঃ)-এর আবির্ভাবকালে নাজদের অবস্থা :

ভৌগলিকভাবে জাযীরাতুল আরবের এক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকলেও নাজদের রাজনৈতিক ইতিহাস অতীতে তেমন সমৃদ্ধ ছিল না। হিজরী তৃতীয় শতকে আববাসীয় আমলে সর্বপ্রথম নাজদ একটি স্বতন্ত্র রাজ্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ২৫৩ হিজরীতে মুহাম্মাদ আল-উখায়যির এ রাজ্যের গোড়াপত্তন করেন। তখন একে
দাওলাতুল উখায়যিরিয়াহ নামে অভিহিত করা হত। কিন্তু হিজরী পঞ্চম শতকের মাঝামাঝিতে নাজদের রাষ্ট্রীয় পরিচয় পুনরায় অবলুপ্ত হয়ে যায় এবং তা পার্শ্ববর্তী রাজ্যসমূহের অংশবিশেষে পরিণত হয়। ওছমানীয় শাসনামলে পর্বতময় নজদ অঞ্চল রাজনৈতিকভাবে আরো গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। সেখানকার অধিবাসীরা অভ্যন্তরীণ গোলযোগ নিয়েই ব্যস্ত থাকত। ক্ষমতা দখলের দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ে বিশৃংখল নাজদ অঞ্চল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চারটি রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ফলে বাইরের দুনিয়ার সাথে তাদের তেমন সম্পর্ক ছিল না।

সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার সাথে পাল্লা দিয়ে সেখানকার ধর্মীয় আচার-আচরণেও নেমে এসেছিল দুর্যোগের ঘনঘটা। শিরক ও বিদ
আতের নোংরা আবর্জনায় হারিয়ে গিয়েছিল তাওহীদ ও সুন্নাতের মর্মবাণী। বিভ্রান্ত ছূফীবাদীদের আধিপত্যে আদি ইসলামের দিশা পাওয়া ছিল নিতান্ত ভাগ্যের ব্যাপার। মানুষ আল্লাহর ইবাদত ছেড়ে কবর, খানক্বাহ, গাছ, পাথর, ওলী নামধারী মুর্খ পাগল-ফকীরের ইবাদতে লিপ্ত ছিল। তারা তাদের নামে পশু কুরবানী করত ও নযর-নেয়াজ পাঠাত। সমাজে গণক ঠাকুর ও জাদুকররা লাভ করেছিল বিশেষ কদর। মানুষ তাদের কথা নির্বিবাদে বিশ্বাস করত। জ্বিনের পূজায় তারা বিশেষ অর্ঘ্য নিবেদন করত এবং তার অনিষ্ট থেকে বাঁচার জন্য নানা শিরকী উপায়-উপকরণের আশ্রয় নিত। যদিও ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাতের মত মৌলিক ইবাদত তারা পুরোপুরি ছেড়ে দেয়নি, কিন্তু তাদের জীবনাচরণ একজন আল্লাহবিমুখ দুনিয়াপূজারী লম্পটের চেয়ে ভিন্নতর ছিল না। তাদের অবস্থা ছিল প্রায় জাহেলী যুগের মুশরিকদের মতই। অজ্ঞতার নিকষ কালো আঁধার তাদের অন্তর থেকে হেদায়াতের নূর নিভিয়ে দিয়েছিল। পথভ্রষ্ট, আর খেয়াল-খুশীর অনুসারী লোকেরা ছিল তাদের নেতৃত্বে। তারা আল্লাহর কিতাব, রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছের ধার ধারত না। পূর্বপুরুষদের বিদআতী আচার-অনুষ্ঠানকেই তারা ইবাদত মনে করত এবং তাদেরকেই সর্বাধিক জ্ঞানের অধিকারী বিবেচনা করত।

ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের উপর সর্বাধিক নির্ভরযোগ্য ইতিহাসবিদ হুসাইন বিন গান্নামের (মৃ: ১৮১১ খৃঃ) বর্ণনায় দেখা যায় যে, নজদের শহরাঞ্চলের মানুষ কবরপূজা (যেমন যিরার ইবনুল আযওয়ারের কবর), গাছপূজা (যীব ও ফুহ্হাল গাছের পূজা), পাথরপূজা (বিনতে উমায়ের পাহাড়ের পূজা), পীরপূজা (তাজুল আ
মার পূজা)- প্রভৃতিতে লিপ্ত ছিল। জুবাইলাতে যায়েদ বিন খাত্ত্বাব (রাঃ)-এর কবর ছিল। যেখানে লোকেরা সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় প্রার্থনার জন্য যেত এবং তাদের প্রয়োজন পূরণার্থে ফরিয়াদ জানাতো। দিরঈইয়াতেও অনেক ছাহাবীর নাম সংযুক্ত কবর ছিল। যেখানে মানুষ হাজত পূরণের উদ্দেশ্যে ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে যেত। সেখানে একটি গুহা ছিল যেখানে তারা নিজেদের মনষ্কামনা পূরণের জন্য গমন করত এবং খাদ্য-দ্রব্য দান করত। তাদের ধারণা ছিল, কতিপয় দুষ্কৃতিকারীর নির্যাতন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পালিয়ে আসা জনৈক বাদশাহর মেয়ে বিনতে উমায়ের এ গুহার নিকট আশ্রয় পেয়েছিল।

ইবনে বিশর বলেন, কার্যত: নাজদের প্রতিটি গোত্রে কিংবা উপত্যকায় গাছ বা কবর ইত্যাদি ছিল, যেখানে মানুষ আশীর্বাদ লাভের আশায় পড়ে থাকত। সরাসরি মূর্তিপূজায় লিপ্ত না হলেও কবরপূজাকে তারা মূর্তিপূজার মতই করে ফেলেছিল।

সার্বিক পরিস্থিতির চিত্রায়ন করতে যেয়ে হুসাইন বিন গান্নাম তাই যথার্থই লিখেছেন-
নজদবাসীদের অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছিল যে, তারা আল্লাহর চেয়ে কবরবাসীদেরকেই অধিক ভয় পেত, তাই তাদের নৈকট্য লাভের আশায় তারা ব্যতিব্যস্ত থাকত, এমনকি তাদেরকেই আল্লাহর চেয়ে অধিক প্রয়োজন পূরণকারী মনে করত।

আর গ্রামাঞ্চলের বেদুঈনদের অবস্থা তো ছিল অবর্ণনীয়। মরুভূমির বিজন শুষ্ক বালুকাময় প্রান্তরে অজ্ঞতার নিকষ কালো অাঁধার তাদেরকে একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জেঁকে ধরেছিল। এমত পরিস্থিতি চলে আসছিল অব্যাহতভাবে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে; যতদিন না নব উষার শুভবার্তা নিয়ে এই নজদেরই সন্তান মুজাদ্দিদে যামান মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব তাঁর বিপ্লবী সমাজ সংস্কার আন্দোলন নিয়ে আবির্ভূত হন।


মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের সংক্ষিপ্ত পরিচয় ও তাঁর সমাজ সংস্কার কার্যক্রম :
নাম, বংশধারা ও জন্ম :
তাঁর নাম মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব বিন সুলায়মান আত-তামীমী। তিনি নাজদের বিখ্যাত তামীম গোত্রের মুশাররফ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।৮ বর্তমান সঊদী আরবের রাজধানী শহর রিয়ায থেকে প্রায় ৭০ কি:মি: দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত উয়ায়না নগরীতে ১১১৫ হিঃ/১৭০৩ খৃষ্টাব্দে তাঁর জন্ম হয়। তাঁর পিতা আব্দুল ওয়াহ্হাব, চাচা ইবরাহীম, দাদা সুলায়মান, চাচাতো ভাই আব্দুর রহমান প্রত্যেকেই ছিলেন নজদের নেতৃস্থানীয় আলেমে দ্বীন কিংবা বিচারপতি। তাঁর বংশধারা বর্তমানে
আলে শায়েখ নামে পরিচিত এবং সঊদী আরবের সাবেক ও বর্তমান গ্রান্ড মুফতী এবং বর্তমান বিচারমন্ত্রী এই বংশোদ্ভূত।

শিক্ষালাভ ও দেশভ্রমণ :
শৈশব থেকেই তিনি ছিলেন প্রখর ধীশক্তির অধিকারী। দশ বছর হ
তে না হতেই তিনি সমগ্র কুরআন হিফয করে ফেলেন। পিতার কাছেই তাঁর দ্বীনী ইলম অর্জনের হাতেখড়ি হয়। দাদা ও পিতাসহ আত্মীয়দের মধ্যে বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা আলেমে দ্বীন হওয়ায় তাঁদের সাহচর্যে শৈশব থেকেই তিনি জ্ঞানচর্চার পরিবেশে বেড়ে উঠেন। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে হাদীছ ও আক্বায়েদ সংক্রান্ত গ্রন্থসমূহের দিকে তাঁর ঝোঁক সৃষ্টি হয়। এই আগ্রহ থেকেই তিনি ইবনে তায়মিয়াহ ও তদীয় ছাত্র ইবনুল ক্বাইয়িমের লিখিত গ্রন্থসমূহ গভীর মনোনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করা শুরু করেন। এমনকি তাদের অনেক গ্রন্থ তিনি নিজ হাতে প্রতিলিপি করেছিলেন।

স্থানীয় আলেমদের নিকট থেকে জ্ঞানার্জন শেষে তিনি বহির্বিশ্ব পরিভ্রমণে বের হন। প্রথমেই তিনি মক্কা মু
আযযামা গমন করেন এবং দ্বিতীয়বারের মত হজ্জ আদায় করেন। সেখানকার আলেমদের সাহচর্যে কিছুদিন থাকার পর তিনি মদীনা গমন করেন। সেখানে বিখ্যাত দুজন আলেম আব্দুল্লাহ বিন ইবরাহীম বিন সায়ফ আন-নাজদী এবং আল্লামা হায়াত সিন্ধীর সাহচর্যে থেকে দীর্ঘদিন জ্ঞানার্জনে ব্যাপৃত থাকেন। তাঁদের কাছে তিনি তাওহীদ, শিরক, সুন্নাত ও বিদআত ইত্যাদি ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারণা পান এবং শিরক ও বিদআতী আমল-আক্বীদার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর প্রেরণা লাভ করেন।

রাসূল (ছাঃ)-এর কবরকে ঘিরে তখন শিরক-বিদ
আতের আড্ডাখানা গড়ে উঠেছিল। বাক্বী কবরস্থানসহ বিভিন্ন কবরস্থানে ছিল পথভ্রষ্ট মানুষের উপচে পড়া ভিড়। এসব দুরবস্থার সাক্ষী হয়ে তিনি নাজদে প্রত্যাবর্তন করেন। অতঃপর ১৯২৪ খৃষ্টাব্দে তিনি ইরাকের বছরা শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং সেখানে প্রখ্যাত সালাফী আলেম শায়খ মুহাম্মাদ আল-মাজমুঈসহ কতিপয় বিদ্বানের নিকট হাদীছ, ফিক্বহ ও আরবী ভাষা শিক্ষা করেন। বছরাতেও তখন শিরক-বিদআতের রমরমা অবস্থা। শীআদের ইমাম ও ওলী পূজার আড়ম্বর ও তাদের দেখাদেখি সুন্নীদের মাঝেও শিরক-বিদআতের নানামুখী প্রচলন দেখে তিনি অস্থির হয়ে পড়েন। অবশেষে স্বীয় ওস্তাদের উৎসাহ পেয়ে তিনি এই পথভোলা মানুষগুলিকে তাওহীদের দিকে প্রত্যাবর্তন ও শিরক পরিহারের জন্য প্রকাশ্যে দাওয়াত প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন।

তৎকালীন প্রেক্ষাপটে তাঁর এই দাওয়াত ছিল বছরাবাসীদের নিকট অভিনব ও অপ্রত্যাশিত। শায়খ নিজেই বলেন,
বছরার মুশরিক লোকেরা আমার কাছে নানা সন্দেহের ঝাঁপি খুলে বসতো আর প্রশ্ন করতো। আমি যখন তাদেরকে বলতাম, একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কারো ইবাদত করা বৈধ নয়, তখন তারা এমনভাবে হতভম্ব হয়ে পড়ত যে, তাদের মুখে রা ফুটত না। ফলে খুব শীঘ্রই তিনি বছরাবাসীদের কোপানলে পড়ে যান এবং সেখান থেকে তাঁকে নিগৃহীত ও কপর্দকশূন্য অবস্থায় বিতাড়িত হতে হয়।১৪ প্রায় ৪ বছর তিনি বছরায় ছিলেন।

ড. আব্দুল্লাহ ইবনুল উছায়মীন বলেন, বছরায় অবস্থানকালে তিনটি বিষয়ে তিনি উপকৃত হন- ১. ফিক্বহ, হাদীছ ও আরবী ভাষায় দক্ষতা লাভ। ২.শী
আদের বিভ্রান্ত আক্বীদা-আমল খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ। ৩. তুমুল বিরোধের মুখে বিভিন্ন প্রশ্ন ও সন্দেহের জওয়াব প্রদানের উপায় সম্পর্কে জ্ঞানলাভ।

বছরা থেকে নাজদে প্রত্যাবর্তনের পথে যুবায়ের পল্লী হয়ে তিনি আল-আহসায় গমন করেন এবং সেখানে শায়খ আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল লতীফের নিকট কিছুকাল অধ্যয়ন করেন। অবশেষে ১৭৩৯ খৃষ্টাব্দের দিকে স্বীয় বাসভূমি নাজদে ফিরে আসেন। আরবের বিভিন্ন প্রান্তে দীর্ঘ সফরের ফলে ইসলামী বিশ্বের দুরবস্থা সম্পর্কে তিনি বিস্তর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। যা তাঁকে অন্তর্জ্বালায় জর্জরিত করে তুলেছিল এবং একটি বৃহত্তর সমাজ সংস্কার আন্দোলন পরিচালনার বীজ তাঁর অন্তরে বপন করে দিয়েছিল।

দাওয়াত ও জিহাদের ময়দানে পদার্পণ :
শিক্ষাজীবনের শুরু থেকেই তিনি শিরক ও বিদ
আতের বিরুদ্ধে সচেতন হয়ে উঠেন এবং পরিপার্শ্বের অজ্ঞ মানুষদের জঘন্যভাবে শিরক-বিদআতে জড়িয়ে থাকতে দেখে তাঁদেরকে আলোর পথে ফিরিয়ে আনার জন্য দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। সমকালীন অন্যান্য আলেমদের মত তিনি জনরোষের ভয়ে স্বীয় ইলমের সাথে প্রতারণা করেন নি; বরং ইলমকে তিনি গ্রহণ করেছিলেন পবিত্র আমানত হিসাবে, যা তাঁর ব্যক্তিত্বকে স্বচ্ছ, সুদৃঢ় ও আপোষহীন করেছিল। তাঁর বিদগ্ধ শিক্ষকবৃন্দ ছিলেন তাঁর জন্য অনুপ্রেরণা। সবকিছু মিলিয়ে শিক্ষাজীবন শেষ করে পিতৃগৃহ হুরাইমিলায়১৮ প্রত্যাবর্তনের পর তিনি স্বীয় আবাসস্থল থেকেই তাঁর কাংখিত আন্দোলন শুরু করেন।

হুরাইমিলা :
১৭২৬-১৭৩৯ খৃঃ (১১৩৯-১১৫৩ হিঃ) পর্যন্ত আনুমানিক প্রায় ১৫ বছর তিনি এই হুরাইমিলাতেই কাটান। এ সময়টি তাঁর জন্য ছিল বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্ত্ততির সময়। প্রাথমিক পর্যায়ে নিজ শহরের অধিবাসীদের মধ্যে তাওহীদের দাওয়াত প্রচার এবং তাদেরকে যাবতীয় শিরকী কর্মকান্ড পরিহার করে এক আল্লাহর ইবাদতের আহবান জানানোর মাধ্যমে তিনি সমাজ সংস্কার আন্দোলন শুরু করলেন। মানুষকে ডাক দিলেন কিতাব ও সুন্নাহর পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ এবং সালাফে ছালেহীনের মানহাজের দিকে প্রত্যাবর্তনের দিকে। স্বভাবতঃই তাঁর দাওয়াত জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করল এবং অধিকাংশই তা প্রত্যাখ্যান করল। শুরু হল তাঁর বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রের অভিঘাত। এমনকি স্বয়ং তাঁর পিতা ও ভাই সুলায়মানের সাথেও তাঁর মতবিরোধ দেখা দিল। কিন্তু তিনি বিচলিত না হয়ে এক আল্লাহর উপর দৃঢ় আস্থা রেখে স্বীয় দাওয়াত ও সমাজ সংস্কার কার্যক্রমে অটল থাকলেন। ১৭২৯ খৃষ্টাব্দে তাঁর পিতার মৃত্যুর পর তিনি দাওয়াতী কাজ পুরোদমে শুরু করলেন। হাদীছ, ফিক্বহ ও তাফসীর বিষয়ে তাঁর জ্ঞানের সুখ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল। ফলে উয়ায়না, দিরঈইয়াহ, রিয়ায, মানফূহা প্রভৃতি স্থান থেকে বহু শিক্ষার্থী তাঁর কাছে জমায়েত হতে থাকে এবং তাঁর অনুরাগী ভক্তে পরিণত হয়। তিনি তাঁর ছাত্রদের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহে দাওয়াতী বার্তাসম্বলিত পত্র প্রেরণ করা শুরু করলেন। সেসব চিঠির ভাষা ছিল খুব হৃদয়গ্রাহী ও যুক্তিপূর্ণ। যেমন তাঁর প্রথম পত্রটি যা আরেযবাসীকে উদ্দেশ্য করে প্রেরণ করেছিলেন, তার একটি অংশ ছিল এরূপ-

হে আরেযবাসী! আমি তাওহীদের বিষয়টি তোমাদেরকে ক্বিবলার মাসআলা দিয়ে বুঝাতে চাই। নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ) ও তাঁর উম্মত ছালাত আদায় করে, নাছারারাও ছালাত আদায় করে। তাদের প্রত্যেকেরই ক্বিবলা রয়েছে। উম্মতে মুহাম্মাদীর ক্বিবলা হ
ল বায়তুল্লাহ শরীফ, আর নাছারাদের ক্বিবলা হল সূর্যোদয়স্থল। যদিও আমরা প্রত্যেকেই ছালাত আদায় করছি, কিন্তু আমাদের ক্বিবলা ভিন্ন। এখন যদি উম্মতে মুহাম্মাদীর কোন ব্যক্তি এ কথা স্বীকার করে নেয়, অথচ বায়তুল্লাহমুখী ছালাত আদায়কারীর পরিবর্তে সূর্য অভিমুখে ছালাত আদায়কারী খৃষ্টানকে ভালবাসে, সে কি মুসলমান থাকতে পারে? সমস্যাটা এখানেই। নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে আল্লাহ তাওহীদ প্রচারের জন্য প্রেরণ করেছেন, আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে আহবান করার জন্য নয়, চাই তিনি নবী হৌন আর যেই হৌন। পক্ষান্তরে নাছারাগণ আল্লাহর সাথে শরীক করে এবং তাদের রাসূল ঈসা (আঃ) ও তাদের সাধু-সন্তদের নিকট প্রার্থনা করে, আর বলে যে, তারা হলেন আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য শাফাআতকারী। অতএব তাওহীদের স্বীকৃতি যখন সকল অনুগামীর মুখেই, তখন তোমরা মুসলিম হিসাবে তাওহীদকে ক্বিবলা করে নাও আর শিরককে সূর্যকে ক্বিবলা করার মত মনে কর; যদিও বাস্তবে তা ক্বিবলার চেয়ে অনেক বড়। তোমাদের আত্মমর্যাদাকে জাগ্রত করার জন্য আমি উপদেশস্বরূপ বলতে চাই, সাবধান! তোমাদের নবীর দ্বীনের পরিবর্তে নাছারাদের দ্বীনকে ভালবেসে আল্লাহর নিকট তোমাদের প্রাপ্য অংশকে হাতছাড়া করো না। ঐ ব্যক্তির পরিণতি সম্পর্কে তোমাদের কী ধারণা, যে ব্যক্তি তাওহীদকে রাসূলের দ্বীন হিসাবে জানা সত্ত্বেও তাওহীদ ও তাওহীদবাদীদের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে? তাকে কি আল্লাহ ক্ষমা করবেন মনে কর? সত্যিই নছীহত কেবল তার জন্যই যে আখেরাতকে ভয় করে। আর যে লোক অন্তঃসারশূন্য তাকে বোঝানোর পথ তো আমাদের জানা নেই।

এ সময়ই তিনি তাঁর বিখ্যাত পুস্তিকা
كتاب التوحيد الذي هو حق الله علي العبيد রচনা করেন। যেখানে তিনি পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের বলিষ্ঠ উদ্ধৃতি প্রদানের মাধ্যমে সহজবোধ্য ভাষায় তাওহীদের স্বরূপ ব্যাখ্যা করেছেন। হুরাইমিলাতে আরো কিছু কাল অবস্থানের পর কোন এক প্রেক্ষাপটে স্থানীয় শাসনকর্তাদের নিকট অত্র অঞ্চলে বসবাসরত দাস গোষ্ঠীভুক্ত দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পরামর্শ দেন। এতে তারা শায়খের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয় এবং তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। ফলে আত্মরক্ষার জন্য অথবা দাওয়াতী কাজের উপযুক্ত পরিবেশের সন্ধানে তিনি হুরাইমিলা থেকে স্বীয় জন্মভূমি উয়ায়নায় যাত্রার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সম্ভবতঃ ১১৫৩ কিংবা ১১৫৫ হিজরীতে তিনি উয়ায়নায় পৌঁছেন।

উয়ায়না :
উয়ায়না পৌঁছার পর সেখানকার শাসক ওছমান বিন মুহাম্মাদ বিন মু
আম্মারের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয় এবং তাঁকে তিনি স্বীয় দাওয়াতের উদ্দেশ্য ও সমাজ-সংস্কার কার্যক্রমের বিষয়বস্ত্ত ব্যাখ্যা করেন। আমীর তাঁর এই দাওয়াতী কর্মসূচীকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাগত জানান এবং তাঁকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের অঙ্গীকার করেন। ফলে তিনি স্বাধীনভাবে স্বীয় দাওয়াতী কার্যক্রম ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ পেলেন। অল্প দিনের মধ্যেই অত্র রাজ্যে যায়েদ বিন খাত্ত্বাব (রাঃ), যিরার ইবনুল আযওয়ার প্রমুখের কবরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শিরকী আস্তানাসমূহ ধ্বংস২৯, বৃক্ষপূজায় ব্যবহৃত বৃক্ষ কর্তন, ইসলামী হুদূদ কার্যকর ও মসজিদে জামাআত সহকারে ছালাত আদায়ের ব্যবস্থা করায় চতুর্দিকে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে এবং উয়ায়নার আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির সার্বিক উন্নতি ঘটে। এভাবে উয়ায়নাকে কেন্দ্র করে একটি পরিপূর্ণ ইসলামী সমাজ গড়ে উঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়। একে একে এ রাজ্য থেকে শিরকের যাবতীয় আস্তানা ধ্বংস করা হয়। দ্বীনের এই নতুন রূপ ধীরে ধীরে মানুষের কাছে সুস্পষ্ট ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে লাগল। এমনকি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহের মানুষ শান্তির প্রত্যাশায় এখানে হিজরত করে আসা শুরু করল। কিন্তু এ দৃশ্য দেখে বিচলিত ও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল বিদআতপন্থী আলেম ও পথভ্রষ্ট লোকেরা। ঈর্ষান্বিত, দুনিয়াপূজারী আলেম নামধারী এসকল ব্যক্তি তাঁর বিরুদ্ধে নানা অপবাদ ও গুজব ছড়িয়ে তাঁর কর্মকান্ডে বাধা সৃষ্টি করতে লাগল। শায়খ আন্তরিকতার সাথে তাদের সব সমালোচনার যুক্তিসংগত জওয়াব প্রদান করলেন। কিন্তু তারা নিবৃত্ত না হয়ে ভিন্ন কৌশল ধরল এবং পার্শ্ববর্তী আহসা রাজ্যের শাসক ও বনী খালেদ গোত্রের প্রধান সুলায়মান আলে আহমাদের নিকট শায়খের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করল। আমীর সুলায়মান শায়খের এই তৎপরতাকে নিজের জন্য হুমকি মনে করলেন এবং তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য উয়ায়নার আমীর ওছমানের ওপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করলেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে ওছমান বিন মুহাম্মাদ শায়খকে উয়ায়না থেকে বহিস্কার করতে বাধ্য হন।

ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের প্রবর্তক শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব নজদী (রাঃ)-এর সংগ্রামী জীবন-


দিরঈইয়া :
১১৫৭ হিঃ/১৭৪৬ খৃষ্টাব্দে তিনি উয়ায়না থেকে বের হয়ে এক স্বাধীনচেতা আমীর মুহাম্মাদ বিন সঊদের শাসনাধীন ছোট্ট নগরী
দিরঈইয়া-তে উপস্থিত হলেন এবং স্বীয় ছাত্র আহমাদ ইবনু সুওয়াইলিমের গৃহে আশ্রয় নিলেন। শীঘ্রই আশ-পাশের অঞ্চলসমূহে তার আগমনের খবর ছড়িয়ে পড়ল। আম জনসাধারণ জ্ঞানার্জনের জন্য এই গৃহে জড়ো হতে শুরু করল। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর আবাসস্থল তাওহীদের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হল। এই ধাপে এসে তাঁর সংস্কার আন্দোলন দাওয়াতের ময়দান ছেড়ে ইলমী ময়দানে এসে উপনীত হয়। ইতোমধ্যে তাঁর খ্যাতির কথা পৌঁছে গেল আমীর মুহাম্মাদ বিন সঊদের দরবারেও। তাঁর সুখ্যাতির কথা জানতে পেরে আমীর মুহাম্মাদ সাগ্রহে স্বয়ং শায়খের দরসগাহে উপস্থিত হলেন এবং তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে বললেন, أبشر ببلاد خير من بلادك وأبشر بالعز والمنعة- আপনাকে খোশ আমদেদ, আপনার দেশের চেয়ে উত্তম এই দেশে। আমি আপনার জন্য মর্যাদা ও প্রতিরক্ষার সুসংবাদ দিচ্ছি। জবাবে শায়খ দৃঢ়কণ্ঠে বললেন,وأنا أبشرك بالعز والتمكين والنصر المبين وهذه كلمة التوحيد وأول ما دعت إليه الرسل من أولهم إلى آخرهم، من تمسك بها وعمل بها ونصرها ملك بها البلاد والعباد- আর আমি আপনাকে সুসংবাদ দিচ্ছি মর্যাদা লাভ, ক্ষমতা অর্জন ও সুস্পষ্ট বিজয়ের। এই সেই তাওহীদের কালেমা; যার দিকে সর্বপ্রথম রাসূলগণ আহবান জানিয়েছিলেন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সকলেই। যে ব্যক্তি তা দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে ও আমলে পরিণত করবে এবং তা প্রতিষ্ঠার জন্য সহযোগিতা করবে, সে রাজ্যসমূহ ও জনগণের উপর ক্ষমতা লাভ করবে। অতঃপর তিনি তাওহীদ ও শিরকের উপর নাতিদীর্ঘ বক্তব্য রাখলেন। তাঁর তেজোদীপ্ত ভাষণে আমীর মুহাম্মাদ বিমোহিত হয়ে পড়লেন এবং হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, يا شيخ إن هذا دين الله ورسوله الذي لا شك فيه وأبشر بالنصر لك ولما أمرت به والجهاد لمن خالف التوحيد হে শায়খ! নিঃসন্দেহে এটাই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রচারিত দ্বীন। আপনি সুসংবাদ গ্রহণ করুন যে, আপনি যা নির্দেশ করবেন সে ব্যাপারে আমি আপনার সহযোগিতায় থাকব এবং তাওহীদের বিরোধীদের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্যও প্রস্ত্তত থাকব। অতঃপর তিনি শায়খের হাতে হাত রেখে বায়আত গ্রহণ করে স্বীয় রাজ্যে আমর বিল মারূফ ও নাহি আনিল মুনকারের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং কিতাব ও সুন্নাত অনুযায়ী জীবন পরিচালনার জন্য অঙ্গিকারাবদ্ধ হলেন। ১৭৪৬ খৃষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত এই ঐতিহাসিক বায়আতই দিরঈইয়া চুক্তি হিসাবে পরিচিত, যা দুই মুহাম্মাদের ভাগ্যকে একসূত্রে গ্রথিত করে দিয়েছিল। আর এর মাধ্যমেই আরব উপদ্বীপের ধর্মীয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ইতিহাস এক নতুন মোড় নিল। সূচনা হল আধুনিক ইসলামী রেনেসাঁ ও আরবীয় গণজাগরণের পাদপীঠে এক গৌরবোজ্জ্বল যুগান্তকারী অধ্যায়ের।

এই চুক্তির পর ছোট্ট দিরঈইয়া রাজ্য অতি শীঘ্রই ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতির দিকে ধাবিত হতে লাগল। আর রাষ্ট্রশক্তির আনুকূল্য শায়খের দাওয়াতী তৎপরতাকেও বাধামুক্ত করে দিল। ফলে নাজদের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষের ঢল নামা শুরু হ
ল তার দরসগাহে। সাধারণ মানুষের মধ্যে তাওহীদের শিক্ষাকে ছড়িয়ে দিতে তিনি খুব সহজ-সরল ভাষায় সবকিছু উপস্থাপন করতেন। যেমন ইসলামের প্রথম কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ-এর মর্মকথা তিনি এভাবে বুঝাতেন- লা ইলাহা অর্থাৎ নেই কোন ইলাহ দ্বারা যাবতীয় উপাস্যকে বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে, আর ইল্লাল্লাহ অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত দ্বারা কেবলমাত্র এক আল্লাহর জন্যই সকল ইবাদত সাব্যস্ত করা হয়েছে, যার কোন শরীক নেই। সুতরাং তাওহীদের অপরিহার্যতা ও শিরক বর্জনের আবশ্যকতা বুঝার জন্য কেবল এই কালেমার মূলকথা বুঝাই যথেষ্ট।

তিনি শিক্ষার্থীদের পাঠদানের সাথে সাথে পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন রাজ্যসমূহের প্রশাসনিক দায়িত্বশীলদেরকে পত্র প্রেরণ শুরু করলেন। পরবর্তী দু
টি বছরও তিনি ব্যস্ত থাকলেন একাধারে দরস-তাদরীস, ইলমী বিতর্ক, আলেম-ওলামা, আমীর-ওমারাদের কাছে চিঠি-পত্র প্রেরণ, পুস্তিকা প্রণয়ন প্রভৃতিতে। নাজদ সহ রিয়ায, আল-ক্বাছীম, হায়েল, সুদায়ের, আহসা, মক্কা, মদীনাসহ আরবের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁর দাওয়াত পৌঁছে গেল। হজ্জের সময় আগত হাজীদের মাধ্যমে বহির্বিশ্বে তথা মিসর, সুদান, সিরিয়া, ইরাক, ইয়ামান, ভারতবর্ষ প্রভৃতি শিরক-বিদআত অধ্যুষিত এলাকায় তাঁর দাওয়াত ছড়িয়ে পড়ল। সাধারণ মানুষের মত অনেক আলেম-ওলামাও তাঁর সমর্থনে এগিয়ে এলেন। ১১৫৮ হিজরীতে পার্শ্ববর্তী উয়ায়না রাজ্যের আমীর ওছমান তাঁর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন এবং স্বীয় রাজ্যে ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েমের অঙ্গীকার করেন। এছাড়া হুরায়মিলা ও মানফূহার অধিবাসীরাও তাঁর হাতে বায়আত গ্রহণ করল। এভাবে জাযীরাতুল আরবে ওয়াহ্হাবী আন্দোলন এক মযবুত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে গেল।

যদিও মুহাম্মাদ বিন সঊদ ছিলেন দিরঈইয়ার প্রশাসনিক প্রধান, তবে কার্যতঃ শায়খই ছিলেন এই রাজ্যের সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী। রাজ্যের সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হ
ত তাঁর পরামর্শ অনুযায়ী। বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিদলের সাথে তিনিই রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধি হিসাবে সাক্ষাৎ করতেন।

এভাবে বাতাস যখন এ আন্দোলনের অনুকূলে প্রবাহিত হচ্ছিল, চতুর্দিকে সম্প্রসারিত হচ্ছিল হক্বের দাওয়াত, মানুষ বিমুগ্ধচিত্তে অবলোকন করছিল নতুন এই আন্দোলনের অভূতপূর্ব ফলাফল; তখন এই নাজদ এবং আরব উপদ্বীপেরই বিভিন্ন অঞ্চলে ঈর্ষান্বিত বিদ
আতপন্থী আলেম-ওলামা, বিভ্রান্ত আমল-আক্বীদার শিখন্ডী ছূফী কবরপুজারী এবং রাজনৈতিক ক্ষমতাধর আমীর-ওমারা তাঁর চূড়ান্ত বিরোধিতায় লিপ্ত হল। তারা তাঁকে খারেজী, কাফের, বিদআতী নানা অপবাদ দিয়ে সাধারণ মানুষকে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলল এবং এ আন্দোলনের অনুসারীদের বিরুদ্ধে মুখোমুখি সংঘাতের চক্রান্ত করল। আল্লামা রশীদ রেযা বলেন, فنهدت لمناهضته واضطهاده القُوى الثلاث: قوة الدولة والحكام، وقوة أنصارها من علماء النفاق، وقوة العوام الطغاة، وكان أقوى سلاحهم في الرد عليه أنه خالف جمهور المسلمين- তাঁর বিরোধিতায় যে তিনটি শক্তির উদ্ভব ঘটেছিল, তারা হল- ১. রাষ্ট্রশক্তি ও প্রশাসনযন্ত্র, ২. সরকারের লেজুড় মুনাফিক আলেম-ওলামা, ৩. উগ্র জনসাধারণ। তাঁর বিরোধিতায় তাদের সবচেয়ে মোক্ষম অস্ত্র ছিল এই যুক্তি যে, তিনি জমহুর তথা অধিকাংশ মুসলমানের আক্বীদা পরিপন্থী মত পোষণ করেছেন (?)।

এমতাবস্থায় শায়খ একদিকে আত্মরক্ষা অন্যদিকে দাওয়াতী কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে অনুসারীদেরকে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্ত্ততি গ্রহণ করার নির্দেশ দিলেন।১৬ ১১৫৯ হিজরীর (১৭৪৮ খৃঃ) মুহাররাম মাসে সর্বপ্রথম সশস্ত্র জিহাদের মুখোমুখি হলেন এ আন্দোলনের অনুসারীরা। দিরঈইয়া ও অন্যান্য স্থান থেকে হিজরত করে আসা শহুরে ও বেদুঈন অনুসারীরা গোত্রীয় বিভক্তির উঁচু দেওয়াল গুঁড়িয়ে ঈমানের পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ের জন্য প্রস্ত্তত হয়ে গেল। এ এক অপূর্ব দৃশ্য, যা প্রায় সহস্র বছর পূর্বে ইসলামের স্বর্ণযুগে পরিদৃষ্ট হয়েছিল। এভাবে আমীর মুহাম্মাদ বিন সঊদের আন্তরিক সহযোগিতায় ওয়াহ্হাবী আন্দোলন অবশেষে চূড়ান্ত স্তর তথা জিহাদের স্তরে উপনীত হ
ল।

১১৭৯/১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে আমীর মুহাম্মাদ বিন সঊদ মৃত্যুবরণ করেন এবং তদস্থলে তদীয় পুত্র আব্দুল আযীয শাসনভার গ্রহণ করেন। তিনিও পিতার মতই শায়খের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন এবং তাঁর নির্দেশনা অনুযায়ী রাজ্য পরিচালনা করতেন। তাঁর আমলে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলসমূহের উপর দিরঈইয়ার নিরংকুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁর হাতেই ১১৮৭ হিঃ/১৭৭৩ খৃষ্টাব্দে দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর লড়াই চলার পর অত্যাচারী শাসক দাহ্হাম বিন দাওয়াসের কর্তৃত্বাধীন রিয়ায নগরী পদানত হয়। এই বিজয়ের পর শায়খ তাদরীস ও তা
লীমের কাজে পুরোপুরিভাবে আত্মনিয়োগ করেন। যদিও আমীর আব্দুল আযীয যে কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাঁর অনুমতি ও পরামর্শ ছাড়া সিদ্ধান্ত নিতেন না।

১২০৬ হিঃ/১৭৯২ খৃষ্টাব্দে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব প্রায় ৫০ বছর যাবৎ দাওয়াত ও জিহাদের এই বন্ধুর ময়দানে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। আমীর মুহাম্মাদ বিন সঊদের মৃত্যুর পর তাঁর পরবর্তী বংশধরগণও তাঁকে সমানভাবে সহযোগিতা করেন এবং তাঁর দাওয়াত ছড়িয়ে দিতে বিরাট ভূমিকা রাখেন। তাঁর তাক্বওয়া, সত্যনিষ্ঠা, অক্লান্ত পরিশ্রম, মেধা, সাহস, দৃঢ়চিত্ততা, পার্থিব মোহহীনতা আর ইখলাছের বরকতে মানুষ বাপ-দাদার আমল থেকে চলে আসা কুসংস্কার ও বিকৃত রসম-রেওয়াজ থেকে পবিত্র হয়ে দলে দলে আবার বিশুদ্ধ ইসলামের দিকে প্রত্যাবর্তন শুরু করল। শিরক ও বিদ
আতের যাবতীয় জঞ্জালকে ধূলিসাৎ করে তদস্থলে তাওহীদ ও সুন্নাতের নতুন রাজপথ নির্মাণ করল। জাযীরাতুল আরব আর হারামাইন শরীফাইন থেকে কবর-মাযার পূজা সংস্কৃতির উচ্ছেদ সাধিত হল চিরতরে। আর তদস্থলে নির্মিত হল নতুন মসজিদ ও ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র। প্রতিষ্ঠিত হল যাকাত আদায় কেন্দ্র ও ইসলামী আদালত। দেশের প্রান্তে প্রান্তে দ্বীনী হুকুম-আহকাম শিক্ষাদানের জন্য দাঈ ও বিচারক প্রেরিত হল। মানুষ দ্বীনকে নতুন করে চিনতে শিখল। মরুময় আরবের বিস্তীর্ণ বালুকাসমুদ্রে দেখা দিল চক্ষু শীতল করা এক প্রশান্ত মরুদ্যান। ফিরে এল সহস্র বছর পূর্বে গত হওয়া সেই দ্বীনী নবজাগরণের প্রাণোচ্ছ্বাস। সর্বত্র বইতে লাগল হক্ব ও ন্যায়ের অনাবিল ফল্গুধারা।
মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাবের হাত ধরে এভাবেই আরবের বুকে আল্লাহর দ্বীনের এক অনন্যসাধারণ বিজয় সাধিত হ
ল। সূচিত হল মুসলিম বিশ্বের জন্য এক অনুসরণীয়, অনুপ্রেরণাদায়ক দৃশ্যপট, যা মহাকালের বুকে গেঁথে দিয়েছে ইসলামের আরো একটি মহত্তম বিজয়ের শুভ্র নিশান।

তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ :
শায়খ মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওয়াহ্হাব তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত করেছেন দরস-তাদরীস আর দাওয়াত ও জিহাদের ময়দানে। হক্বের দাওয়াতকে সর্বমহলে পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি প্রচলিত প্রায় সব মাধ্যমই ব্যবহার করেছিলেন। খুৎবা প্রদান, পত্র প্রদান, প্রতিনিধি প্রেরণ, শিক্ষাদান, ইলমী বিতর্ক, গ্রন্থ রচনা এবং সর্বশেষ জিহাদের ময়দানে পদার্পণ- অর্থাৎ এমন কোন ক্ষেত্র বাকী ছিল না যেখানে তিনি পদচারণা করেননি। বাস্তব কর্মজগতে এই ব্যস্ততার ফলে তাঁর রচিত গ্রন্থসমূহ প্রচলিত অর্থে
গ্রন্থ হয়ে উঠেনি; বরং তা হয়েছে মানুষের কাছে দাওয়াত পৌঁছনোর একটি মাধ্যম। তাই তাঁর প্রায় রচনাই দেখা যায় খুব সংক্ষিপ্ত, সহজ-সরল এবং সর্বজনবোধ্য ভাষায় রচিত। এজন্য লেখক হিসাবে তাঁর মূল্যায়নে স্প্যানিশ বংশোদ্ভূত বিশিষ্ট আমেরিকান গবেষক জামালুদ্দীন জারাবোজো যথার্থই লিখেছেন, তাঁর প্রকৃত জ্ঞানবত্তা ও লেখনী শক্তির পরিচয় তাঁর লিখিত গ্রন্থের চেয়ে বরং চিঠি-পত্রেই অধিক প্রকাশ পেয়েছে।

তাঁর রচনায় ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ বা ইবনুল ক্বাইয়িম প্রমুখ সংস্কারকের মত পান্ডিত্য অথবা ছূফীবাদী, মুতাকালিলম, ফিক্বহবিদ বা গ্রীক দর্শনের প্রভাবপুষ্ট দার্শনিকদের মত জটিল ভাববিলাস, যুক্তি-তর্ক ও উন্নত ভাষাশৈলীর সমাহার নেই; কিন্তু এটা সুনিশ্চিত যে, যা লিখেছেন তা একেবারেই জটিলতামুক্ত, অকপট, সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন। একমাত্র পবিত্র কুরআন ও সুন্নাহকেই উৎস হিসাবে গ্রহণ করেছেন বলে কোনরূপ অতিরঞ্জন, অতিকথন সেখানে স্থান পায়নি। তাঁর লেখকসত্তার বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে এখানেই। তবে সবচেয়ে বড় কথা, তাঁর সংক্ষিপ্ত এ ক
টি পুস্তিকাই এমন একটি বিপ্লবী আন্দোলনের জীবন্ত স্বাক্ষর বহন করে চলেছে, যা সমগ্র মুসলিম বিশ্বজুড়ে এক বিরাট পট-পরিবর্তনকারী ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কার আন্দোলনে সফল নেতৃত্ব দিয়েছে। তাই জামালুদ্দীন আফগানী সম্পর্কে আমীর শাকীব আরসালানের করা একটি প্রসিদ্ধ মন্তব্য শায়খের ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য-فإنه لم يكن يحفل بوفرة التصانيف وإنما كان يؤلف أمما ويصنف ممالك- অর্থাৎ তিনি অধিক লেখনীর বহর রেখে যেতে পারেননি বটে; কিন্তু রচনা করে গেছেন জাতিসমূহ আর রাষ্ট্রসমূহের ভিত্তি

তাঁর লিখিত পুস্তকসংখ্যা ১৬টির অধিক। যার মধ্যে
কিতাবুত তাওহীদ (كتاب التوحيد ) সর্বাধিক প্রসিদ্ধ। এ গ্রন্থটিকে তাঁর আন্দোলনের সারনির্যাস বলা চলে। এর বেশ কয়েকটি আরবী ভাষ্যগ্রন্থ রচিত হয়েছে। যার মধ্যে ফাতহুল মাজীদ গ্রন্থটি আরববিশ্বে বিশববিদ্যালয় পর্যায়ের পাঠ্যসূচীভুক্ত।২৪ তার পরবর্তী রচনা কাশফুশ শুবহাত (كشف الشبهات) পূর্ববর্তী গ্রন্থেরই উপসংহার হিসাবে লিখিত হয়েছে। এছাড়া অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- উছূলুছ ছালাছাহ ওয়া আদিল্লাতুহা (الأصول الثلاثة وأدلتها ), কিতাবুস সীরাহ (كتاب السيرة) -যেটি সীরাতে ইবনে হিশামের তালখীছ (সংক্ষিপ্তসার) হিসাবে রচিত হয়েছে, আল-হাদিউন নবভী الهدي النبوي) )-যেটি যাদুল মাআদের তালখীছ হিসাবে রচিত হয়েছে এবং মাসায়েলুল জাহেলিয়াহ (مسائل الجاهلية) - যেটি প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব কর্তৃক ইসলাম ও জাহেলিয়াতের দ্বন্দ্ব শিরোনামে বাংলায় অনুদিত হয়েছে। তাঁর অধিকাংশ লেখনী আক্বীদা বিষয়ক। বাকিগুলো তাফসীর, হাদীছ, ফিক্বহ এবং ইতিহাস বিষয়ক। এছাড়া দেশ-বিদেশের আলেম-ওলামা ও আমীর-ওমারাদের নিকট তাঁর প্রেরিত চিঠিপত্রসমূহকে একত্রিত করেছেন তাঁর ছাত্র হুসাইন বিন গান্নাম স্বীয় গ্রন্থে। যা পরবর্তীতে পৃথকভাবে ৩৭৩ পৃষ্ঠায় গ্রন্থাবদ্ধ হয়ে চিঠিপত্র সমগ্র নামে প্রকাশিত হয়েছে।২৫ ১৯৮০ খৃষ্টাব্দে রিয়াযের মুহাম্মাদ বিন সঊদ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শায়খের রচনাসমগ্র, চিঠিপত্র ও ফৎওয়াসমূহ একত্রিত করে ১২ খন্ডের একটি সংকলনগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে।

শায়খের সহযোগীবৃন্দ ও ছাত্রবৃন্দ :
শায়খ এক দিক দিয়ে খুব ভাগ্যবান ছিলেন এই জন্য যে, তিনি তাঁর দাওয়াত প্রসারে যোগ্য সাথী পেয়েছিলেন, যা পৃথিবীর অধিকাংশ সংস্কারকের ভাগ্যে জুটেনি। দিরঈইয়ার আমীরের সাথে বায়
আতবদ্ধ হওয়ার পর আমীরসহ আমীরের তিন ভ্রাতা মুশারী, ছুনিইয়ান ও ফারহান তাঁকে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেন। দিরঈইয়ার ওলামায়ে কেরামের মধ্যে যারা তাঁর অন্তরঙ্গ সহযোগী ছিলেন তাদের মধ্যে মুহাম্মাদ আল-হুযাইমী, আব্দুল্লাহ বিন দুগায়ছীর, সুলায়মান আল-উশায়ক্বারী ও মুহাম্মাদ বিন হুসায়েনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বৃটিশ কুটনৈতিক ফিলবী লিখেছেন, এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের এক এক জন বীর যোদ্ধা, যাদের নাম আজও পর্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হয়। এঁদের উত্তরাধিকারীরাও ওয়াহ্হাবী রাজত্বের কেন্দ্রস্থলে বিশেষ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী বিবেচিত হতেন।

শায়খের ছাত্ররাও তাঁর জন্য বিরাট সম্পদে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর অগণিত ছাত্রের মধ্যে শতাধিকই নবগঠিত ওয়াহ্হাবী রাজ্যের বিশিষ্ট আলেম ও বিচারক হিসাবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। ওয়াহ্হাবী আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ দিকপালদের মধ্যে আমীর মুহাম্মাদ বিন সঊদের পুত্র আব্দুল আযীয ও তদীয় পুত্র সঊদ বিন আব্দুল আযীয ছিলেন তাঁরই ছাত্র ।

এছাড়া শায়খের ছাত্র হিসাবে তাঁর চারজন সন্তান এবং তাঁদের সন্তানেরাও এ আন্দোলনের প্রচার ও প্রসারে বিরাট ভূমিকা পালন করেন। জেষ্ঠ্য সন্তান হুসাইন দৃষ্টিহীন হওয়া সত্ত্বেও যোগ্য আলেমে দ্বীন হিসাবে প্রসিদ্ধি অর্জন করেন এবং দিরঈয়ার বিচারক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তদীয় পুত্র আলী, হাসান, আব্দুর রহমান প্রত্যেকেই রাষ্ট্রীয় বড় বড় দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। দ্বিতীয় সন্তান আব্দুল্লাহ খ্যাতনামা আলেম ও লেখক ছিলেন। তিনি সঊদ বিন আব্দুল আযীযের সাথে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং বীর বিক্রমে যুদ্ধের পর শত্রুসৈন্যদের হাতে বন্দী হন। পরে যুদ্ধবন্দী হিসাবে মিসরে নীত হন এবং সেখানেই কারারুদ্ধ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। তৃতীয় সন্তান আলীও খুব মুত্তাকী ও পরহেযগার আলেম ছিলেন। তাঁকে বিচারক পদের জন্য নির্বাচন করা হ
লেও তাক্বওয়াশীলতার কারণে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। কনিষ্ঠ সন্তান ইবরাহীমও একজন শিক্ষাগুরু ছিলেন। ঐতিহাসিক ওছমান বিন আব্দুল্লাহ বিন বিশর ছিলেন তাঁরই ছাত্র। তিনিও বিচারকের দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। শায়খের পৌত্রদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতি লাভ করেছিলেন শায়খ আব্দুর রহমান বিন হাসান যিনি একাধারে রিয়ায নগরীর বিচারক ও খ্যাতনামা লেখক ছিলেন। তাঁর সন্তানরাও আপন আপন ক্ষেত্রে খ্যাতির অধিকারী হয়েছিলেন।

অন্যান্য খ্যাতনামা ছাত্রদের মধ্যে আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ আল-হুসাইন, হামাদ বিন নাছির বিন ওছমান বিন মু
আম্মার, মুহাম্মাদ বিন সুওয়াইলিম, আব্দুর রহমান বিন খুমাইয়িস, হুসায়েন বিন গান্নাম প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
[চলবে]
আহমদ ভাই, আপনি অনেক ভাল লিখেছেন ।
মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাবকে নিয়া আমার জানার বেশ আগ্রহ ছিল । আবদুল মওদুদের 'ওহাবী আন্দোলন' আর আব্বাস আলী খানের 'বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস' পড়ে যতটুকু জেনেছিলাম তাতে পিপাসা সম্পূর্ণ মিটে নাই । তারপর মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাবের লেখা 'কিতাবুত তাওহীদ', 'তিনটি মৌলনীতি ও তার প্রমাণপঞ্জী', 'Nullifier of Eeman' বইগুলো পড়ে আমার পিপাসা আরো বেড়ে গেল । তারপর পেয়ে গেলাম Jamal ad-Din Jarabozo-র লেখা প্রায় চারশতপৃষ্ঠার বই "The Life, Teachings and Influence of Muhammad Ibn Abdul Wahhab" । মোটের উপর বলছি, আপনি সংক্ষেপে ভাল লিখেছেন । আপনার লেখায় অতিরঙ্জন নেই । আল্লাহ আপনার কল্যান করুন ।
Link : Tahrik

৩টি মন্তব্য:

  1. বাবারে অনেক কথাই শুনলাম। কিন্তু আসলে উক্ত বিষয়গুলো কী সত্য???
    তাহলে আসুন একটু জেনে নেই যে, এই নাজদী কে?


    মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নজদী পরিচিতিঃ
    কা’বা শরীফের পূর্ব দিকের একটি মরুময় ঘৃণিত অঞ্চলকে নজদ বলে। এ অঞ্চলের অধিকাংশ অধিবাসীরা আল্লাহ পাক-এর গযবপ্রাপ্ত এবং হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর অভিশপ্ত। মক্কা বিজয়ের পর হযরত নবী করিম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নজদকে আরবের অন্যান্য দেশ হতে পৃথক করে ঘৃণিত অঞ্চল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। যেমন তিনি খানায়ে কা’বার সঙ্গে সম্পর্ক করে বলেন, রোকনে ইয়ামনী, রোকনে শামী ও রোকনে ইরাকী। কিন্তু এখানে রোকনে নজদী বলে হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কা’বা শরীফের দিক চিহ্নিত করেননি। কারণ নজদীরা প্রকৃত কা’বা শরীফ পন্থী ছিল না।
    রাসুল পাক (ﷺ) –এর ইসলাম প্রচার কালে কা’বা শরীফের চতুর্দিকে কাফিররা ইসলামী আদর্শে মুগ্ধ হয়ে দ্বীন ইসলামে দীক্ষিত হন। আর মক্কা শরীফ হতে দূর দূরান্তে অবস্থারত অধিবাসীরা হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর চরিত্র মুবারক ও আদর্শ মুবারকে মুগ্ধ হয়ে কালাম পাক-এর মহাবানীতে উদ্ধুদ্ধ হয়ে তারা ওফদ নাম ধারন করত মক্কা শরীফ অভিমুখে রওয়ানা হন।
    সে সময় তাঁদের কারো কারো মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল “ইয়া নবী আল্লাহ” আর কারো মুখে উচ্চারিত হতো আযানের বাক্যবলীর আল্লাহু আকবার। তাঁরা দূরদূরান্ত হতে কা’বা শরীফ-এর আঙ্গিনাতে ঊপস্থিত হয়ে হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাত মুবারকে বাইয়াত গ্রহন করত দ্বীন ইসলাম গ্রহন করে ধন্য হয়েছেন। এমনকি “নসীবাইনের” জ্বিন জাতি পর্যন্ত রসূলে পাক হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর হাত মুবারকে বাইয়াত গ্রহন করেন। কিন্তু কম বখত কোন নজদী হুজুর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর খিদমতে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহন করেনি। বরং নজদীরা ঈমান লাভের পরিবর্তে ঈমানদারগণকে নির্মমভাবে শহীদ করতো। এ কথার জ্বলন্ত প্রমাণ নজদের বীরে মাঊনাতে ৭০ জন ঈমানদার মুবাল্লিগ হাফিযে কুরআন ছাহাবা রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমকে শহীদ করা ও “রজি” এর ঘটনাতে হযরত খুবাইব রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুকে শুলে ঝুলিয়ে শহীদ করা। এ দুটি ঘটনার বিস্তারিত আলোচনা বুখারী শরীফের মধ্যে বর্ণিত আছে।
    হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নজদ ও নজদীদের সম্পর্কে কি কি অভিমত পোষণ করেন সে ব্যাপারে ছহীহ সনদ সূত্রে কয়েকটি হাদীছ শরীফ নিম্নে বর্ণিত হলো-
    মিশকাত শরীফের দ্বিতীয় খণ্ডের ইয়ামান ও শামের বর্ণনা অধ্যায়ে বুখারী শরীফের বরাত দিয়ে হযরত আব্দুল্লাহ ইব্‌নে উমর(রা) থেকে বর্ণিত, একদিন দয়ার সাগর রাসুলুল্লাহ(ﷺ) সব প্রদেশের জন্য দোয়া করলেন, “হে আল্লাহ, আমাদের শাম প্রদেশে বরকত দাও। হে আল্লাহ, আমাদের ইয়ামান প্রদেশে বরকত দাও” শুধু নজদ প্রদেশের জন্য করলেন না, উপস্থিত সাহাবীর মধ্যে একজন বললেন,”ইয়া রাসুলুল্লাহ(ﷺ), আমাদের নজদের জন্য দোয়া করুন।” পুনরায় হুযুর(ﷺ) ইয়ামান ও শামের জন্য দোয়া করলেন, নজদের জন্য করলেন না। এভাবে ৩ বার নজদের জন্য দোয়ার প্রার্থনা করা সত্ত্বেও তিনি শুধু ইয়ামান ও শামের জন্য দোয়া করলেন, নজদের জন্য করলেন না। বরং শেষে বললেন,” যে অঞ্চল সৃষ্টির আদিকাল থেকেই অনুগ্রহ বঞ্চিত, তার জন্য কি করে দোয়া করি, ওখানেই ইসলামের ভিতকে নাড়াদানকারী ভূকম্পন ও ফিত্‌না আরম্ভ হবে, ওখানেই শয়তানী দলের আবির্ভাব হবে(ওখান থেকেই শয়তানের দুটি শিং বের হবে)।“
    সেখানকারই তথাকথিত শেখ নজদী হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ঘুমন্ত অবস্থায় শহীদ করার জন্য আবু জাহিলকে কুপরামর্শ দিয়েছিল। তাই হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাহি ওয়া সাল্লাম যখনই পূর্বমূখী হতেন, তখনই তিনি পূর্ব দিককে অভিশপ্ত আখ্যায়িত করে বদ দুয়া করতেন।
    P.T.O---

    উত্তরমুছুন
  2. হুযূর পাক (ﷺ)- এর উক্ত হাদীছ শরীফটির দ্বিতীয় অংশে বলেন, ওখান থেকেই শয়তানের দুটি শিং বের হবে। দ্বিতীয় বাক্যটির মধ্যে করনুশ শয়তান বা শয়তানের প্রথম শিং মিথ্যা নুবুওওয়াতের দাবীদার মুসায়লামাতুল কাজ্জাবকে এবং দ্বিতীয় শিং দ্বারা মোহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওহাব নজদীকে বুঝানো হয়েছে। হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ভবিষ্যদ্বানীটি অক্ষরে অক্ষরে বাস্তব রূপ ধারণ করেছে।
    অনুরূপ, মিশকাত শরীফের ১ম খণ্ডের কিসাস শীর্ষক আলোচনায় মুরতাদদের(ধর্মদ্রোহী) হত্যা অধ্যায়ে নাসায়ী শরীফের উদ্ধৃতি দিয়ে হযরত আবু বারযা(রাদিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত যে, “একবার হুযুর(ﷺ) কিছু গনীমাতের মাল বণ্টন করছিলেন, তখন পেছন থেকে একজন লোক বললেন, হে মুহাম্মাদ, আপনি ন্যায় সংগত বণ্টন করেন নি। হুযুর(ﷺ) রাগান্বিত হয়ে বললেন, আমার থেকে বেশি ন্যায় পরায়ন ও ইনসাফকারী ব্যক্তি পাওয়া যাবে না। তারপর বললেন, শেষ জমানায় এর বংশ থেকে একটি গোত্রের উদ্ভব হবে, যারা কুরান পাঠ করবে, কিন্তু কুরআন তাদের কণ্ঠের নিচে পৌছবে না।(অর্থাৎ কলবে বসবে না) তারা ইসলাম থেকে এমন ভাবে দূরে সরে যাবে, যেমন করে তীর শিকার ভেদ করে বের হয়ে যায়। তারপর বললেন মাথামুণ্ডানো এদের বিশেষ চিহ্ন। এদের একের পর এক বের হতেই থাকবে। শেষ পর্যন্ত এদের শেষ দলটি দাজ্জালের সাথে মিলিত হবে। যদি তোমরা তাদের সাক্ষাত পাও তবে যেনে রেখ, তারা হল সৃষ্টির মধ্যে সবচেয়ে নৃশংস।”
    নবীজী(ﷺ) আরো বলেছেন, “যদি আমি তাদের পেতাম তবে আদ গোত্রের মত হত্যা করতাম”।
    এ হাদিসে এদের পরিচয় বর্ণনা করা হয়েছে। মাথামুণ্ডানো ছাড়া এখনো কোন ওহাবী পাওয়া মুশকিল। এই ভবিষ্যতবাণী অনুসারে দ্বাদশ হিজরীতে নজদে মুহাম্মাদ বিন আব্দুল ওহাব নজদীর জন্ম হয়। তিনি আহলে হেরমাইন ও অন্যান্য মুসলমানদের উপর কি ধরণের অত্যাচার করেছে, তার বিস্তারিত বিবরণ জানতে হলে “সায়ফুল জব্বার” ও “বোয়ারেকে মুহাম্মাদিয়া আলা ইরগামাতিন নজদিয়াহ” ইত্যাদি ইতিহাস গ্রন্থাবলী দেখুন। এছাড়া আল্লামা শামী(র) তাঁর সুপ্রসিদ্ধ কিতাব রদ্দুল মুখতার এর ৩য় খণ্ডে বর্ণনা করেছেন।
    প্রথম শিংকে (মুসায়লামাতুল কাজ্জাবকে) দমন করা হয় হযরত আবূ বকর ছিদ্দীক রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর খিলাফত কালে।
    আধুনিক কালের শয়তানের শিং (মুহম্মদ বিন আব্দুল ওহাব নজদী) এর জন্ম ১৭০৩ সালে নজদ প্রদেশে। তাঁর অনুসারীদের বলা হয় ওহাবী। ১৮০১ ইং ওহাবীরা কারবালার পবিত্র ভূমি হতে হযরত ইমাম হুসাইন রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু-এর পবিত্র মাযার শরীফ ভেঙ্গে দেয়। ১৮০৩ ঈসায়ী সালে মক্কা শরীফ আক্রমণ করে কাবা শরীফ-এর গিলাফ ছিড়ে ফেলে।আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম, আওলিয়ায়ে কিরাম ও ছাহাবায়ে কিরাম রদ্বিয়াল্লাহু তায়ালা আনহুমগণের মাযার শরীফসমূহ ভেঙ্গে ফেলে। ১৮০৪ ঈসায়ী সালে মদীনা শরীফ আক্রমণ করে। এই পবিত্র স্থানটি ১৮১৩ ঈসায়ী সাল পর্যন্ত ওহাবীদের দখলে ছিল। তাদের অধীনে থাকা অবস্থায় তারা জান্নাতুল বাক্বীর সকল মাযার শরীফসমূহ ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছিল। এমনকি হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর রওযা শরীফ-এর উপরও ঘৃণিত কালো থাবা বিস্তার করেছিল। ওহাবীরা যে কুফরী কর্মে লিপ্ত হয়েছিল তা পবিত্র কুরআন শরীফে ঘোষিত কাফিরগণও এরূপ অপকর্মে লিপ্ত হয়নি।

    উত্তরমুছুন
  3. # প্রশ্ন :

    হাদিসে নাকি এসেছে নজদ থেকে শয়তানের শিং বের হবে। আব্দুল ওহাবের পুত্র মুহাম্মদ তিনিও তো সেই নজদেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কাজেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক শুদ্ধি আন্দোলন তথা মুহাম্মদি আন্দোলনটাই কি হাদিসে উল্লিখিত শয়তানের শিং?

    ## জবাব :

    হাদিসটির মর্মার্থ বর্ণনায় রেজভিপন্থী ভাণ্ডারী সুন্নীরা জঘন্যতম অপব্যাখ্যা করে থাকে। এ সম্পর্কে বিদগ্ধ আলেম ইমাম আলী দানিশ রহঃ তাঁর “বাতিল সেকান” নামক কিতাবে যে তথ্য পরিবেশন করেছেন, তা সংক্ষেপে উল্লেখ করছি।

    সহীহ বুখারীর সে অনুচ্ছেদের শিরোনাম হল باب خروج الفتنة من قبل المشرق (বাবু খুরূজিল ফিতনাহ মিন কিবালিল মাশরিক)। অর্থাৎ মদিনার ‘পূর্ব দিক’ থেকে ফেতনা প্রকাশের বিবরণ।

    এ শিরোনামের অধীনে উল্লিখিত একটি হাদিসের শেশাংশে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেন যে, সেখান থেকে (অর্থাৎ মদিনার পূর্ব দিকের নজদ থেকে) শয়তানের শিং প্রকাশ পাবে।

    অথচ মজার ব্যাপার হল, আব্দুল ওহাবের পুত্র মুহাম্মদ (১৭০৩-১৭৮৬ইং) যে তামীম গোত্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তারা মদিনার পূর্ব দিকের নয়, বরং দক্ষিণ দিকে

    উত্তরমুছুন