বিশ্বজিৎ ও আমরা
২৩
বছরের দর্জি শ্রমিক বিশ্বজিৎ। যাচ্ছিল তার কর্মস্থলে। হঠাৎ পড়ে যায় ‘অবরোধ’
বিরোধীদের কোপানলে। দৌড়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় পার্শ্ববর্তী দোতলায় এক দোকানে। গুন্ডারা
ছুটল সেখানে। ধরে এনে রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশের সামনে লাঠিয়ে-কুপিয়ে
হত্যা করল। অতঃপর বিজয় উল্লাস করতে করতে চলে গেল। বিশ্বজিৎ বারবার বলেছে ‘আমি
শিবির নই, আমি হিন্দু’। কারণ সে ভেবেছিল হিন্দুরা সরকারী দলের ভোটব্যাংক হেতু সে মুক্তি
পাবে। কিন্তু তাতে কাজ হয়নি। বিশ্বজিৎ চলে গেল। কিন্তু সত্যিই সে বিশ্বকে জিতে
নিল। সবার অন্তরে সে স্থায়ী মমতার আসন দখল করে নিল। হত্যাকারীরা সবাই জগন্নাথ
বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারী দলের ছাত্র ক্যাডার। যে পিতারা তাদের সন্তানদের মানুষ করার
জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন। যারা দিন-রাত পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে
সন্তানের জন্য ঢাকায় টাকা পাঠাতেন ছেলে মানুষ হবে বলে, পরে পত্রিকায় ও টিভিতে
ছেলের হন্তারক ছবি দেখে প্রত্যেকে ঘৃণায় ছি ছি করেছেন ও তাদের কঠোর শাস্তি দাবী
করেছেন। ইতিমধ্যে হত্যাকারী শাকিলের পিতা আনছার মিয়া হার্টফেল করে গত ১৫ই ডিসেম্বর
শনিবার সকালে বরিশাল মেডিকেলে মারা গেছেন। বিশ্বজিৎ যদি মুসলমান নামের কেউ হ’ত, তাহলে নির্ঘাৎ তাকে ‘শিবির’ বানিয়ে ছাড়তো। যেমন চাক্ষুষ
প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও ছাত্রলীগ নেতারা বলছে যে, হত্যাকারীরা জামাত-শিবিরের
ক্যাডার। তারা ছাত্রলীগের কেউ নয়। ২০০৬ সালের ২৮শে অক্টোবর লগি-বৈঠাধারীরা ঢাকায়
অনুরূপ নিরীহ এক বয়স্ক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করে তার পিঠের উপর দাঁড়িয়ে নেচেছিল
জামায়াত-শিবির মারার আনন্দে। সেই দল এখন ক্ষমতায়। অতএব কে এদের ঠেকায়। তবে এইসব পোষা গুন্ডাদের হাত থেকে বাঁচার জন্য লেখক ফারূক
ওয়াসিফের একটা সুন্দর পরামর্শ আছে। যেটা অনুসরণ করা যায়। গত ১২ই ডিসেম্বর ‘প্রথম
আলো’-তে তিনি লিখেছেন, ভেবেছিলাম বিনা কারণে বা বিনা বিচারে নিশ্চয়ই
নিহত হব না। কিন্তু সপ্তাহ দু’য়েক আগে সেই বিশ্বাসও টলে যায়। রাত সাড়ে ১১-টায় মোহাম্মদপুরের
আদাবরের কাছে দাঁড়িয়েছিলাম আমরা চারজন। বাড়ির সামনে এক চায়ের দোকানে চা খাচ্ছি।
হঠাৎ একটি সাদা গাড়ি থেকে চার-পাঁচজন ৪০-৪৫ বছর বয়সী লোক নেমেই লাথি-ঘুষি মারতে
থাকল। তারা বলছিল, অ্যারা শিবির, শ্যাষ কইরা ফালা’। আমাদের তিনজন ছিলাম
সাংবাদিক। সবাই পরিচয়পত্র দেখালাম, বোঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু তারা উত্তেজিত।
আগের দিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ম.খা. আলমগীর যুবলীগের প্রতি শিবির প্রতিরোধের আহবান
জানিয়েছিলেন। আদাবর এলাকায় এই গ্রুপটি সম্ভবতঃ সেই জোশেই ... টগবগ করছিল। ক্যাডার,
ছিনতাইকারী আর সরকারী বাহিনীর সাথে তর্ক করলে বিপদ বাড়ে, এই হুঁশ থাকায় উচ্চবাচ্য
না করে প্রহার সইলাম। ভাবছিলাম ক্যাম্পাসে শিবির প্রতিরোধ করেছি, জীবন নাশের
হুমকির মুখেও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। এই তার পুরস্কার! বা শিবির হলেই
কি কাউকে এভাবে মারা যায়? দেশপ্রেমিক সৈনিকদের (?) ধন্যবাদ, তারা আমাদের প্রাণে
মারেনি। সেদিন রাতে আমরাও বিশ্বজিৎ হয়ে যেতে পারতাম। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আহবানের
এমনই তেজস্ক্রিয়তা! আমাকে প্রহৃত হয়ে আর বিশ্বজিৎকে ছিন্নভিন্ন হয়ে সেই তেজের
শিকার হ’তে হয়। তারপরও তিনি সম্পূর্ণ দায়মুক্ত’।
চট্টগ্রাম
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ১৩ই ডিসেম্বর’১২
একই পত্রিকায় ‘রাজনৈতিক বর্বরতা’ শিরোনামে লিখেছেন, শিবিরের উত্থান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৮৬
সালের ২৬শে নভেম্বর তারা ছাত্রদলের আব্দুল হামীদের হাতের কবজিসহ কেটে নিয়ে কিরিচের
মাথায় গেঁথে সারা ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে তাদের হিংস্রতার মাত্রা জানান দেয়।
জাতীয়তাবাদী শিক্ষক নেতা ডঃ এনামুল হকের ছেলে ছাত্রদল কর্মী মূসাকে লোহার রড দিয়ে
পিটিয়ে হত্যা করে। ছাত্রদলের চবি সভাপতি হেলালীকে ১০জনে মিলে টেবিলের উপর চেপে ধরে
দু’জনে তার চোখ উপড়ে ফেলতে চেষ্টা করে। এমন সময় প্রক্টরের হস্তক্ষেপে
সে রক্ষা পায়। চট্টগ্রাম পলিটেকনিকের ছাত্রদল কর্মী যমীর ও জসীমকে জবাই ও গুলি করে
নৃশংসভাবে হত্যা করে শিবিরকর্মীরা’।
দেশের
কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র রাজনীতির নৃশংসতার খতিয়ান যদি এভাবে পেশ করা হয়,
তাহলে তা সহজে শেষ হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আসিফ নজরুল ১৫ই ডিসেম্বর
বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে ‘পশু বানানোর কারখানা’ শিরোনাম দিয়ে লিখেছেন,
কি অসাধারণ রাষ্ট্র! কি অসাধারণ রাজনীতি! এই রাজনীতি হলে সীট পেতে ছাত্রলীগ বা
ছাত্রদল করতে শেখায়। সীট অব্যাহত রাখতে জোর করে মিছিলে গিয়ে দুই নেত্রীর বন্দনা
করতে শেখায়। চাকরী-ব্যবসা পেতে হলে বা বড় নেতা হতে হ’লে
লুটেরা বা খুনী হতে শেখায়। এই রাজনীতি ক্লাসরুম বাদ দিয়ে রাজপথ শেখায়, বই বাদ দিয়ে
দরপত্র পড়া শেখায়, ... মানুষ নয়, পশু বানানোর দীক্ষা দেয়’।
... ‘আমাদের কেউ কেউ বোকার মতোই হয়ত ভাবি, এই পোড়া দেশে কখন আসবে সুদিন!
এই দেশেই এসেছিল বাহান্ন, ঊনসত্তর, একাত্তর আর নববই! আমরা ... বলি। আছে
ছাত্রলীগ-ছাত্রদলের ভয় আর শিবিরের তান্ডব। আছে জেল-যুলুমের হুমকি, গুম হওয়ার শীতল
আতংক! আছে বিশ্বজিতের নির্বোধ আকুতির মুখচ্ছবি। তবু আমরা হারব না’!
তাঁর এই মহতী আশা নিয়ে সবাই বেঁচে থাকে। তাইতো তিনি লিখেছেন, ‘বিশ্বজিৎ
হত্যাকারীদেরও একদিন সুদিন আসবে। তারা তো দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশেই
রাজপথে শিবির প্রতিরোধে নেমেছিলেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুলের নির্দেশে তো
সিটি কর্পোরেশনের আবর্জনাবাহী গাড়ী ভাংচুর করতে যায়নি! মির্জা ফখরুল সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার
হয়েছেন। ৩৭টি মামলায় আসামী হয়েছেন কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। বিশ্বজিৎ হত্যাকারীদের অন্তত
এতটা ভোগান্তি সইতে হবে না। বিরোধী দলের মহাসচিবের চেয়ে নিজ দলের খুনীদের মর্যাদা
এখনো বেশী আছে এই রাষ্ট্রে। ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় এলে হয়ত একই রকম ঘটনা ঘটবে’।
হ্যাঁ,
বিএনপি-জামায়াতের গণতন্ত্রের নমুনা আমরা দেখেছি ২০০৫-এর ফেব্রুয়ারীতে। নিজেদের
লালিত জঙ্গীদের বাঁচাতে গিয়ে আমাদের উপর জঙ্গী অপবাদ চাপিয়ে রাতের অন্ধকারে বাসা
থেকে গ্রেফতার করেছিল। অতঃপর সঙ্গে সঙ্গে দেশের ৬টি যেলায় খুন, বিস্ফোরণ, ব্যাংক
ডাকাতির মতো ১১টি মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠায়। যার ঘানি আমরা এখনো টানছি।
তাদের কয়েকজন নেতা সম্প্রতি গ্রেফতার হয়েছেন ও কয়েকজন তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে
সপ্তাহব্যাপী অবরুদ্ধ আছেন। তাই তারা বলছেন, ‘গণতন্ত্র অবরুদ্ধ রেখে
সরকার বিজয় দিবসের চেতনাকে ধূলিসাৎ করেছে’।
তাহ’লে
প্রশ্ন দাঁড়ায়, গণতন্ত্র অর্থ কী? বিজয় দিবসের চেতনা কী? সেটা তো বিশ্বজিৎ! গত ৯ই
ডিসেম্বর বিজয়ের মাসে যার তরতাযা দেহটাকে মুহূর্তের মধ্যে ছিন্নভিন্ন করে রাজপথে
ফেলে গেল মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী সোনার ছেলেরা। বৃটিশ চলে যাওয়ার পর থেকে বিগত ৬৫
বছর ধরে আমরা গণতন্ত্র দেখছি। যা কখনোই দেশে স্থিতি আনেনি। যেমন কথিত ‘আরব
বসন্ত’ আরব বিশ্বে স্থিতি আনেনি। অতএব দায়ী ঐ ক্যাডাররা নয়, বরং দায়ী হ’ল
সিস্টেম। দল ও প্রার্থীভিত্তিক নেতৃত্ব নির্বাচনের সিস্টেম। এখান থেকে বেরিয়ে আসার
সাহস আমাদের আছে কি?
বিশ্বজিৎ
হৌক আর জামাত-শিবির হৌক প্রত্যেকে এদেশের নাগরিক। তাদের নাগরিক অধিকার অবশ্যই
অক্ষুণ্ণ রাখতে হবে। যদি এগুলো সরকারের পেটুয়া বাহিনী দ্বারা ভূলুষ্ঠিত হয়, তাহলে
মিথ্যা এ স্বাধীনতা, মিথ্যা সব চেতনার বুলি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা তো ছিল একটাই।
যালেমের বিরুদ্ধে মযলূমের স্বভাবগত প্রতিরোধের চেতনা। পাকিস্তানী শাসকরা যদি যুলুম
না করত, আর ভারত সরকার যদি এই ক্ষোভকে কাজে না লাগাতো এবং রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে শেষ
পর্যন্ত যুদ্ধে নেমে না পড়ত, তাহলে ইতিহাসটা কেমন হ’ত? যখন বর্বর টিক্কা
খান হুংকার দিয়েছিল ‘আদমী নেহী, মেট্টি চাহিয়ে’ (মানুষ নয়, মাটি চাই),
আর নিরীহ মানুষের উপর সমানে গুলি চালাচ্ছিল, তখন মানুষ যে যা পেয়েছে তাই নিয়ে
যুদ্ধে নেমে পড়েছিল। কারু আহবানে বা ঘোষণায় তারা যুদ্ধে নামেনি। কারণ
মুক্তিযুদ্ধের কোন পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না। অথচ যালেমের বিরুদ্ধে মযলূমের এই
পবিত্র চেতনাকে ছিনতাই করে নিয়ে সুবিধা লুটছে একদল মতলবী লোক। তাই তো দেখি বহু
প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন, যারা ঘৃণায় মুক্তিযোদ্ধার সনদ পর্যন্ত নেননি। কিন্তু
দলীয় চেতনার চাপে সত্য চেতনা বিকশিত হ’তে পারছে কি?
প্রশ্ন হ’ল,
মানুষের দীর্ঘশ্বাসের জবাব কি? এক যালেমের বিদায়ে আরেক যালেম? নমরূদের বদলে
ফেরাঊন? আদৌ তা নয়। এর জবাব একটাই। মানুষকে মানুষের দাসত্ব নয়, আল্লাহ্র দাসত্ব
বরণ করে নিতে হবে। তাঁর সার্বভৌমত্বকে স্বীকার করতে হবে। তাঁর বিধানকে সর্বোচ্চ
অগ্রাধিকার দিতে হবে। তাহ’লেই কেবল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়িত হবে। মেজর জলিলের ন্যায়
অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা এই চেতনাই লালন করতেন। আমরাও আল্লাহ্র নিকট ছিরাতে
মুস্তাক্বীমের হেদায়াত প্রার্থনা করি- আমীন! (স.স)।Link : www.at-tahreek.com/january2013
assalamualikuwarahmatullah,bhai pir majar shomporke quran haisher dolil soho likban,in shaa allah
উত্তরমুছুনধন্যবাদ
উত্তরমুছুনশাহজাহান.